লায়লী-মজনু : পদ্য ও গদ্য
লায়লী-মজনুর নাম হয়তো আমরা অনেকেই জানি। লায়লী-মজনু নিয়ে বিভিন্ন কবি ও লেখক রচনা করেছেন নানা আখ্যান, গান, কবিতা; নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। বাংলাভাষীদের কাছে যে লায়লী-মজনু পরিচিত, তা রচনা করেন মধ্যযুগের কবি দৌলত উজির বাহরাম খাঁ। এ কাব্যের কাহিনীর উৎস আরবের লোকগাথা। যদিও আরবিতে এর লিখিত কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না। লায়লী-মজনু নামের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ফারসি কবি রুদকির (মৃত্যু ৯৪০ সালে) খণ্ড কবিতায়। এর পর ১১৮৮ সালে ফারসি কবি নিজামি গঞ্জভি প্রথম আখ্যান আকারে লিখিত রূপ দেন। দিল্লির কবি আমির খসরুও লায়লী-মজনু কাব্য লিখেছেন, ১২৯৮ সালে। পারস্যের কবি আবদুল্লাহ হাতিভি ১৫৩১ সালে লায়লী-মজনু রচনা করেন। এর পর এ ধারায় কাব্য রচনা করেন হিলালি আস্ত্রাবাদি, দামিরি, কাসেমি, গুণাবাদি, আরিফ লাহোরি প্রমুখ ইরানীয় ও ভারতীয় কবি।
বাঙালি কবি দৌলত উজির বাহরাম খাঁ রচিত লায়লী-মজনু কাব্যের রচনাকাল নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। কারো মতে ১৫৪৫ থেকে ১৫৫৩ সালের মধ্যে, কারো মতে ১৫৬০ থেকে ১৫৭৪ সালের মধ্যে কবি বাহরাম খাঁ লায়লী-মজনু কাব্যটি রচনা করেন। বাহরাম খাঁর এই লায়লী-মজনু কাব্যটি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ সৃষ্টি। মধ্যযুগের দেব-দেবীকেন্দ্রিক সাহিত্যের মধ্যে মানুষ যেখানে অদৃশ্য, বাহরাম খাঁর লায়লী-মজনু কাব্যে মানুষ তেমনি প্রকাশ্য। কবি দুটি বালক-বালিকার প্রণয়কে উপজীব্য করে গড়ে তুলেছেন একটি বিয়োগান্তক আখ্যান। মঙ্গলকাব্যের যুগের কবি হয়েও বাহরাম খাঁ লায়লী-মজনু রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর আধুনিক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।
তবে লায়লী-মজনু কাব্যটির ‘নামের’ সঙ্গে যতটা পরিচিত মানুষ, ঠিক ততটাই অপরিচিত ‘কাব্যের’ সঙ্গে। বাংলা সাহিত্যের সম্মান পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা কাব্যটি সম্পর্কে জানতে পারত তাদের পাঠ্যক্রমে তা অন্তর্ভুক্ত থাকায়, তা-ও খুব সামান্যই। এর কারণ প্রধানত কাব্যটির ভাষা। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে পাঁচশ বছর আগের বাংলা ভাষায় কাব্যটি পড়তে এবং পড়াতেও অসুবিধায় পড়তে হয়। এ সমস্যার সমাধান আরো আগে হওয়া দরকার ছিল। দীর্ঘদিন এ নিয়ে কেউ ভাবেনি, অন্তত তা দৃশ্যমান নয়। এ দেশে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষার্থীরা মূলত আহমদ শরীফ সম্পাদিত ‘লায়লী-মজনু’ কাব্যটি পড়ে থাকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সেখানেও পর্যাপ্ত অর্থ সন্নিবেশিত নেই, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কাব্যটির প্রকৃত রস আস্বাদন করতে পারবে; আর সাধারণ পাঠকের কথা তো বলা বাহুল্য। কাব্যটিকে সাধারণ শিক্ষার্থী ও পাঠকের কাছে সহজবোধ্য ও আদরণীয় করতে লেখক ও সাহিত্য-গবেষক এইচ এম মেহেদী হাসান এগিয়ে আসেন তাঁর ‘লায়লী-মজনু : পদ্য ও গদ্য’ গ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে। তিনি প্রথমে কাব্যে ব্যবহৃত প্রায় দেড় হাজার প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় শব্দের বর্তমান চলিত অর্থ বের করেন; পরে আখ্যানটিকে চলিত গদ্যে রূপান্তরিত করেন। কাব্যের হুবহু গদ্যরূপ দেওয়া অসম্ভব। মূল কাহিনীর মৌলিকতা বজায় রেখে গদ্যে রূপান্তরের ক্ষেত্রে তিনি খুব সাবধানতা অবলম্বন করার চেষ্টা করেছেন। বইটির শুরুতে দীর্ঘ ভূমিকায় রয়েছে কাব্যটি সম্পর্কে সুবিস্তৃত আলোচনা, যেখানে দৌলত উজির বাহরাম খাঁর মূল কাব্যের কাহিনীর উৎস ও সময়কাল নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে, রয়েছে মূল কাব্যের বৈশিষ্ট্য, কবির কবিত্ব নিয়ে পর্যালোচনা। কাব্যে ব্যবহৃত প্রাচীন ও আরবি-ফারসি শব্দগুলো আলাদা করে তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া লায়লী-মজনুর আখ্যান যে সমাজ ও সংস্কৃতিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে, সে সমাজ-সংস্কৃতির স্বরূপও তুলে ধরা হয়েছে। পুরো কাব্যে রয়েছে অসংখ্য সদুক্তি, রূপক, উপমা ও উৎপ্রেক্ষাদি অলংকারের সার্থক প্রয়োগ, যেগুলো সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে। দীর্ঘ ভূমিকার পর বাহরাম খাঁর মূল ‘লায়লী-মজনু’ শুরু হয়েছে। কাব্যের শব্দ ও বানানের ক্ষেত্রে আদিম রূপই রাখা হয়েছে। আহমদ শরীফ তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থে লায়লী-মজনুর কাহিনী শেষ হওয়ার পরও যুক্ত করেছেন বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত পুঁথির অংশসহ তাঁর গবেষণালব্ধ নানা দিক। কিন্তু এ গ্রন্থে শুধু বাহরাম খাঁর মূল কাব্যটুকু সংযোজন করা হয়েছে। এর পর শুরু হয়েছে গদ্যরূপ অংশ। তবে গদ্যরূপের অংশটুকু লেখা হয়েছে বর্তমান চলিত বানানরীতি অনুসরণ করে। পঙ্ক্তি ধরে ধরে গদ্যে রূপান্তর করা হয়নি, তবে এতে কাহিনীর পরম্পরতা বোধকরি বিনষ্ট হয়নি। গদ্যরূপের পর সবশেষে যুক্ত করা হয়েছে কাব্যে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় শব্দের অর্থ ও টীকা। বর্ণানুক্রমিকভাবে সাজানো প্রায় দেড় হাজার শব্দার্থ ও টীকা পাঠককে প্রয়োজনে কাঙ্ক্ষিত অর্থটি খুঁজে পেতে সহায়তা করবে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বলা যায়, শিক্ষার্থী ও সাধারণ পাঠকের কাছে সহজবোধ্য ও জনপ্রিয় করতে বইটিতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। আশা করি, শিক্ষার্থী ও সাধারণ পাঠকমহলে ‘লায়লী-মজনু : পদ্য ও গদ্য’ বইটি ইতিবাচক সাড়া ফেলতে সক্ষম হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর।