ভলতেয়ারের গল্প
প্লেটোর স্বপ্ন
ভূমিকা
লেখক, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক ফ্রাঙ্কো ম্যারিক অ্যারোয়েট ভলতেয়ার ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২১ নভেম্বর প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। জগদ্বিখ্যাত ফরাসি এ দার্শনিক খ্রিস্টান সমাজ, গির্জা ও তৎকালীন ফরাসি সমাজের আচারকে বিদ্রুপ করে লিখেছেন অসংখ্য লেখা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে লেখার কারণে কারাবরণ থেকে নির্বাসন- সবকিছুই সয়েছেন তিনি। অনূদিত এই ছোট গল্পটিও ধর্মের অসারতার বিরুদ্ধে পরোক্ষ এক আক্রমণ। ১৭৫৬ সালে প্রকাশিত এ ছোট গল্পে পৃথিবী কিংবা বাকি সৌরজগত যে ঈশ্বরের নিখুঁত কোনো সৃষ্টি নয়, প্রকারান্তরে সেটাই তিনি প্লেটোর স্বপ্নের ওপর ভর করে জানান দিলেন কট্টর ধর্মবিশ্বাসীদের। wondersmith.com থেকে সংগৃহীত এ লেখা অনুবাদ করেছেন রেশমী নন্দী।
প্রাচীন কালে, স্বপ্ন দেখাটাকে বেশ সম্মানের চোখে দেখা হতো আর প্লেটো ছিলেন অন্যতম এক স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন যথাযথ কারণেই প্রসিদ্ধ কিন্তু এখানে তাঁর যে স্বল্প পরিচিত স্বপ্নের গল্প শোনানো হবে, তা তাঁর অত্যাশ্চর্য এক স্বপ্ন কিংবা দুঃস্বপ্ন। বিশাল জগতের অসীম পরিসর নিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শাশ্বত নকশাকার ডেমিয়ার্গস যখন বিক্ষিপ্ত, তখন তিনি একদিন স্থির করলেন তাঁর সৃষ্টি অনুচর, যারা তাঁর কাজের সঙ্গে পরিচিত, তাঁদের জ্ঞানের দৌড় যাচাই করবেন।
আমাদের শিক্ষকরা যেমন মূর্তি খোদাই করতে দিয়ে কিংবা ছবিতে রং লাগাতে দিয়ে দেখার চেষ্টা করেন, আমরা প্রতিকৃতি থেকে সত্যিকারের অবয়ব বুঝতে পারি কি না, ঠিক তেমনভাবেই ডেমোগর্গনদের প্রত্যেকের হাতে তিনি সামান্য কিছু উপাদান তুলে দিলেন।
পৃথিবীর নকশাকে তিনি তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে মনে করেন আর তাই ডেমোগর্গনরা সেই পৃথিবীর ছাঁচে তৈরি করলেন বর্তমানের এই পৃথিবী। তিনি ভেবেছিলেন যে এমন সৃষ্টি ঈর্ষাকেও স্তব্দ করে দেবে, সহদেবতাদের প্রশংসাবাক্যে ভেসে যাবেন তিনি। কিন্তু বিস্ময়করভাবে তিনি দেখলেন যে এ সৃষ্টি সবার সামনে উপস্থানের পরই অননুমোদনের গুঞ্জন উঠল সভায়।
সমালোচনাকারীদের একজন যিনি সবচেয়ে বাঁকা কথা বলেছিলেন, তাঁর মন্তব্য ছিল এমন, ‘সত্যি কী অপূর্ব নকশাই না আপনি করেছেন! দুনিয়াকে আপনি দুইভাগ করেছেন এবং এ দুই গোলার্ধের কেউ যাতে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে সেজন্য বিশাল জলধারা দিয়েছেন মাঝখানে। দুই মেরুর বাসিন্দারা মরবে ঠান্ডায়, আর জ্বলে মরার ব্যবস্থা রেখেছেন নিরক্ষরেখার বাসিন্দাদের। আপনার অশেষ বুদ্ধি দিয়ে আপনি বিরাট বালির মরুভূমি বানিয়েছেন যাতে সেখানে যারা ভ্রমণ করবেন তারা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় প্রাণ হারায়। আপনার গরু, ভেড়া, মোরগ-মুরগি তৈরিতে কোনো সমস্যা না থাকলেও সাপ বা মাকড়সা যেভাবে বানিয়েছেন সেটা মেনে নেওয়া কঠিন। পেঁয়াজ বা কাঁটা ডাঁটা ফুল ভালোই, কিন্তু পৃথিবীর বাসিন্দাদের মেরে ফেলার ইচ্ছে ছাড়া আর কী কারণে বিষাক্ত গাছ সৃষ্টি হতে পারে সেটা আমি বুঝতে পারছি না। তার ওপর, আমি যদি ভুল না করে থাকি, আপনি ৩০টিরও বেশি প্রজাতির বানর, অসংখ্য প্রজাতির কুকুর তৈরি করেছেন, কিন্তু মানুষের প্রজাতি বানিয়েছেন সবে চার কি পাঁচ ধরনের। এটা ঠিক যে শেষ প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে, আপনি যাকে বলেন কাণ্ডজ্ঞান, তা দিয়েছেন, কিন্তু যেভাবে তার প্রয়োগ হবে তা বিবেচনায় আনলে একে মূর্খামি বলাই সংগত।
তা ছাড়া, এ দুপেয়ে প্রাণীর বিষয়ে আপনি খুব বেশি মনোযোগ দেননি, এর চারপাশে হাঙ্গামা দিয়েছেন প্রচুর কিন্তু আত্মরক্ষার ব্যবস্থা রেখেছেন খুবই অপ্রতুল, প্রতিকারের উপায়ও তেমন দেননি। এদের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ জীবন দিয়েছেন কিন্তু তা সামলে রাখার মতো জ্ঞান এবং দূরদর্শিতা দিয়েছেন খুবই কম। বোঝা যাচ্ছে যে আপনার চান যে এ ধরনের প্রাণীরা পৃথিবীতে যত কম থাকবে ততই ভালো। কারণ সামনের দিনগুলোতে গুটি বসন্তে নিয়মিতই এক দশমাংশ দুপেয়ে জীব মারা পড়বে, এ ছাড়া নানা ধরনের অসুখ বাকিদের জীবনও তছনছ করে দেবে। তার ওপর, কেবল এসবে সন্তুষ্ট না থেকে আপনি এমন ব্যবস্থা করেছেন যাতে এদের অর্ধেকই আইনআদালতে ধরনা দেওয়ায় ব্যস্ত থাকে নয়তো নিজেরাই নিজেদের গলায় ছুরি বসায় এবং এত সব কিছুর পরও আপনি বিধান রেখেছেন যে এরা অবশ্যই যেন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে। স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে কী অভূতপূর্ব সৃষ্টিই না আপনি করেছেন।’
ডেমোগর্গনরা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। তিনিও এখন বুঝতে পারছেন তাঁর কাজে প্রাকৃতিক ও নৈতিক বিবেচনায় অনেক খারাপ বিষয় রয়েছে। তবে, এখনো তিনি মনে করেন, খারাপের চেয়ে ভালো বিষয়ই এতে বেশি আছে।
‘কারো ভুল ধরা খুবই সোজা’ তিনি বললেন, ‘কিন্তু তোমার কি ধারণা এমন একটা প্রাণী বানানো খুব সোজা যার স্বাধীন চিন্তা আর যুক্তিবোধ থাকা সত্ত্বেও মাঝেমাঝে তার স্বাধীনতার অপব্যবহার করবে না? তোমার কি মনে হয় যে ১০ হাজারের মতো গাছ তৈরির সময় দু'চারটা বিষগাছের জন্ম ঠেকানো খুব সহজ কাজ? কী করে ভাবতে পার যে এ পরিমাণ পানি, বালি আর কাদা নিয়ে কাজ করার পরও সাগর কিংবা মরুভূমি ছাড়া কোনো একটা গোলক তৈরি করা যায়।
তো এত যে বিদ্রুপ করলে বন্ধু, আমি জানি, তুমি সবে বৃহস্পতি গ্রহ তৈরি করেছ। আমাদের দেখতে দাও, যে বিখ্যাত বলয়, চার চারটা চাঁদের আলো ছড়ানো দীর্ঘ রাতের ব্যবস্থা রেখে কি বস্তু তুমি বানিয়েছ? তোমার বানানো কীর্তিও আমাদের পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ দাও, যাতে আমরা জানতে পারি যে, সেখানকার বাসিন্দারা মূর্খতা বা অসুখবিসুখের শংকামুক্ত কিনা।’
অতঃপর, অন্য দেবতারা বৃহষ্পতিগ্রহের খুঁটিনাটি দেখতে শুরু করলো এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসি শুরু হয়ে গেলো এ নিয়ে। শনিগ্রহের স্রষ্টাও পার পেল না। এরপর একে একে সমালোচনার মুখে পড়লো মঙ্গল, বুধ, শুক্রগ্রহের স্রষ্টারাও।
সর্বশক্তিমান ডেমিয়ার্গস না থামানো পর্যন্ত দেবতারা একে অপরকে নিয়ে সমালোচনা আর হাসাহাসি করতেই থাকল।
‘তোমাদের কাজে ভালো খারাপ দুটোই আছে, কারণ তোমাদের রয়েছে অন্তর্দৃষ্টি তবে পুরোপুরি নিখুঁত কাজ হয় নি এগুলো। তোমাদের এসব সৃষ্টি কেবল কয়েক লক্ষ কোটি বছর টিকবে। তারপর এখানকার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আরো ভালো কিছু তৈরি করতে পারবে তোমরা। কেবল আমিই নিখুঁত আর অমর কিছু সৃষ্টি করতে পারি।’
"অর্থাৎ, আমরা?" ডেমোগর্গনরা জানতে চাইল।
মহান দেবতা ডেমিয়ার্গস তাদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল আর ঠিক সেই সময় জেগে উঠলেন প্লেটো।
সত্যিই জাগলেন?