কমরেড মুজফফর আহমদ
সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রদূত
১৯১৭ সাল। অবসান ঘটে রাশিয়ায় জার শাসনের। সফলতা লাভ করে লেনিন-স্টালিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক অভ্যুত্থান। রাশিয়াতে গঠিত হয় পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এর ঢেউ এসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের অন্য সব দেশে। তৎকালীন অবিভক্ত ভারতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর সে সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে গঠিত হয় ভারতের সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক দল। গঠন করেছিলেন বাঙালি নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায়। এর মাত্র এক মাসের মধ্যে অবিভক্ত বঙ্গেও গঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক দল। এই সংগঠনের পুরোধা ছিলেন মুজফফর আহমদ। তাঁর হাত ধরেই যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন।
১৮৮৯ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপের মুসাপুর গ্রামে এক দরিদ্র কিন্তু অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মুজফফর আহমদ। তাঁর বাবা মনসুর আলী এবং মা চুনাবিবি। চুনাবিবি ছিলেন মনসুর আলীর দ্বিতীয় স্ত্রী।
পেশায় মনসুর আলী ছিলেন সন্দ্বীপের এক স্বল্প আয়ের মোক্তার। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না বলে কৈশোরেই চাষাবাদের কাজে যোগ দিতে হয় মুজফফরকে। এদিকে বহির্মুখী মুজাফফরকে গৃহমুখী করার লক্ষ্যে পারিবারিক চাপে ১৯০৭ সালে বিয়ে দেওয়া হয়। স্ত্রী হাফেজা খাতুনের সঙ্গে নিয়মিত সাংসারিক জীবন পালন করতে পারেননি তিনি। ১৯৩৫ সালে নজরবন্দি থাকার সময় ১৪ বছর পর পরিবারের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর।
মুজাফফর আহমদ তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন বাংলাভাষা শিক্ষার মধ্য দিয়ে। ১৮৯৭ সালে তিনি ভর্তি হন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৮৯৯ সালে তিনি হরিশপুর মিডল ইংলিশ স্কুলে (পরে কাগিল হাইস্কুল) ভর্তি হন। পিতার মোক্তারি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর স্কুল থেকে কেটে দেওয়া হয় তাঁর নাম। সে সময় মাদ্রাসা শিক্ষা অবৈতনিক হওয়ায় তিনি লেখাপড়া শুরু করেন মাদ্রাসায়। ১৯০৫ সালে বাবার মৃত্যুর সময় তিনি নোয়াখালীর বামনী মাদ্রাসায় পড়ছিলেন। বাবার মৃত্যুতে পরিবারে নেমে আছে অভাব-অনটন। ফলে মুজফফরকে কিছু দিন গৃহশিক্ষকতা করতে হয় বরিশালে। এরপর তিনি আবার ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। ভর্তি হন স্কুলে। ১৯১০ সালে তিনি কাগিল হাইস্কুল ছেড়ে চলে যান নোয়াখালী জেলা স্কুলে। ১৯১৩ সালে সেখান থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯১৩ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় তিনি সে বছরেই চলে যান বঙ্গবাসী কলেজে। এ কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হলে সেখানেই ইতি ঘটে তাঁর লেখাপড়ার।
সন্দীপের কাগিল হাইস্কুলে পড়ার সময়ই মুজফফর আহমদের হাতেখড়ি হয় সাংবাদিকতায়। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক সুলতান’ পত্রিকায় সন্দীপের স্থানীয় খবর পাঠাতেন তিনি। এদিকে ১৯১১ সালে কলকাতায় অবস্থানরত বিভিন্ন মুসলিম ছাত্রের উদ্যোগে গঠিত হয় বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি। কলকাতার ৩২ কলেজ স্ট্রিটে ছিল এ সাহিত্য সমিতির অফিস। ১৯১৮ সালে সমিতির উদ্যোগে বের হয় ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা’। ১৯১৮ সালে সমিতির সব সময়ের কর্মী হিসেবে তিনি এর অফিসেই থাকা শুরু করেন। তিনি ছিলেন সমিতির সহকারী সম্পাদক। পত্রিকার কাজ পরিচালনার সময় চিঠিপত্রের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের। ১৯২০ সালের শুরুর দিকে ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হলে নজরুলের সৈনিক জীবনের অবসান ঘটে। এর ফলে কলকাতায় নজরুল সাহিত্য সমিতির অফিসে থাকতে শুরু করেন মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে।
সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদানের আগে মুজাফফর আহমদ চাকরি করেছেন কিছু দিন। বাংলা সরকারের ছাপাখানায় মাসিক ৩০ টাকা বেতনে চাকরি করেন তিনি। বাংলা সরকারের অনুবাদ বিভাগেও তিনি চাকরি করেছেন। মাসিক ৫০ টাকা বেতনে এক মাস উর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদ করার কাজ করেন। এ ছাড়া এক মাস তিনি প্রেসিডেন্সি বিভাগের স্কুলগুলোর ইনস্পেক্টর হিসেবেও কাজ করেন। কলেজে পড়ার সময় খিদিরপুর জুনিয়র মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষকতা করেন আর এক মাস ছুটিতে তিনি কাজ করেন কলকাতা সিটি করপোরেশনে। ১৯০৬ সাল থেকে ১৯০৮ সালের অধিকাংশ সময় তিনি কোনো না কোনো লোকের বাড়িতে গৃহশিক্ষকতা করে থাকা-খাওয়া অথবা অর্থ রোজগার করেছেন।
বাবার পেশা মোক্তারি হলেও মুজাফফর আহমদের পরিবার ছিল মূলত কৃষক পরিবার। তা ছাড়া তাঁদের গ্রামের অর্থনীতিও ছিল কৃষিভিত্তিক। কলকাতা জীবনের শুরু থেকেই নাবিকদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন শ্রমিক শ্রেণির দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে। সে সময় সন্দীপের অনেক লোক কাজ করতেন কলকাতা বন্দরে। আধুনিক শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার প্রতি আকর্ষণ এবং বুদ্ধিজীবীদের সাহচর্য লাভের ফলে ধর্মনিরপেক্ষতা ও কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির রাজনীতিতে আগ্রহী করে তুলেছিল মুজাফফরকে।
কৈশোরে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও ১৯১৬ সাল থেকে মুজাফফর আহমদ বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক আলোচনা, সভা-সেমিনার-মিছিলে যোগদান শুরু করেন। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের সাফল্য তাঁকে উদ্দীপ্ত করে। ১৯২১ সালে থেকে তিনি আত্মনিয়োগ করেন মার্কসবাদ চর্চা ও মার্কসবাদী রাজনীতিতে। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কলকাতার অনুষ্ঠিত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯২০ সালে বঙ্গীয় খেলাফত কমিটির সদস্য মনোনীত হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯২০ সালের শুরুতে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে রাজনীতিই হবে তাঁর জীবনের মূল পেশা। তিনি কাজী নজরুলের সঙ্গে ঠিক করেন একটি ভিন্নধর্মী বাংলা দৈনিক বের করার। এ বিষয়ে তাঁরা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সঙ্গে দেখা করেন। হক সাহেব তাঁর নিজের টাকায় পত্রিকা বের করার প্রস্তাব করেন। ১৯২০ সালের ১২ জুলাই মুজাফফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলামের যুগ্ম সম্পাদনায় সান্ধ্য-পত্রিকা ‘নবযুগ’ প্রকাশিত হয়।
মুজাফফর আহমদের ছাত্রাবস্থায় শুরু হয় বাংলায় সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুধু হিন্দু আন্দোলন ছিল না, আসলে তা ছিল বর্ণ হিন্দুদের আন্দোলন।’ তাঁর মতে, একধরনের রোমাঞ্চের জন্য শিক্ষিত যুবকরা এতে অংশ নিলেও এর পেছনে ছিল একটা গভীর নৈরাশ্য। যদিও তিনি এই আন্দোলনের জন্য জীবন উৎসর্গকারীদের শ্রদ্ধা করতেন। অন্যদিকে মুসলীম লীগ ও কংগ্রেসকে তিনি মনে করতেন ধনীক শ্রেণির স্বার্থে ধনীক শ্রেণির রাজনৈতিক দল হিসেবে। কংগ্রেসের ঘোষণাপত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা থাকলেও এ দল ধীরে ধীরে হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নেতাদের কর্তৃত্বাধীন হয়ে পড়ে। মুসলিম লীগের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে অসাম্প্রদায়িক হলেও ধর্মকে ব্যবহার করতেন রাজনৈতিক স্বার্থে। মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে হিন্দু সুবিধাভোগী শ্রেণির একাধিপত্যকে রোধ করার জন্যই জন্ম হয় মুসলিম সুবিধাভোগী ও ভোগেচ্ছুদের রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের- এমনটাই মনে করতেন মুজাফফর আহমদ।
১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর প্রয়াত হন ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের এই অন্যতম অগ্রদূত।