জাবিতে বাহা বঙ্গা উৎসব

বাংলাদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব হচ্ছে বাহা পরব। গ্রামীণ সংস্কৃতি থেকে দূরে থেকেও নিজেদের ঐতিহ্য আর পরম্পরা বাঁচিয়ে রাখতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাহা বঙ্গা উৎসব।
বাহা পরব কী?
বাহা হচ্ছে সাঁওতালদের প্রধান উৎসব। বাহা শব্দের আক্ষরিক অর্থ ফুল। সেজন্যই বাহা উৎসবকে ফুল বা বসন্ত উৎসব নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। অষ্ট্রিক গোষ্ঠীর মুণ্ডা বা হো আদিবাসীরা এই উৎসবকে সাহরুল নামে পালন করে থাকে।
সাঁওতালরা পহেলা মাঘকে নতুন শস্য বর্ষ সূচনার প্রথম দিন হিসাবে পালন করে। সেদিন থেকেই জমিতে লাঙ্গল দিয়ে কৃষি কার্যের সূচনা করা তারা। আর দোল পূর্ণিমার পর চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রতিটি সাঁওতাল গ্রামে বাহা উৎসব পালিত হয়।
বাহা পরবের সূচনা
শাল পলাশ ফুল ফোটার সাথে সাথেই বাহা উৎসবের আগমনী বার্তা ঘোষিত হয়। পুরোনো পাতা ঝরে যাওয়ার পর নতুন পাতা ও ফুল দিয়ে যখন প্রকৃতি ভরে ওঠে তখনই সাঁওতাল গ্রামে গ্রামে বাহা উৎসবের সাড়ম্বর ঘোষণা শুরু হয়। মহুল ফুলের কুঁড়ি উদ্গমের সাথে সাথেই যুবক-যুবতীদের মধ্যে উৎসব পালনের প্রস্তুতি শুরু করে। প্রকৃতি যখন নতুন সাজে সেজে ওঠে শাল পলাশের রঙে ও গন্ধে তখন প্রকৃতির পূজারী আদিবাসীদের মধ্যেও আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়।

কৃষি কাজ শুরু হওয়ার পূর্বে আদিম সাম্যবাদী সমাজে মানুষ যখন প্রকৃতি নির্ভর ছিল তখন শীতের শেষে গাছের পাতা ঝরে যাওয়ায় নতুন পাতা ও ফুলে গাছগুলো যখন ভরে ওঠে তখনই নতুন প্রকৃতিকে বরণের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি অধিক ফলমূল দিয়ে মানব জীবনকে নিরাপত্তা দেবে এই কামনাতেই বাহা উৎসবের' সূচনা।
মেয়েরা খোঁপায় নতুন ফুল গুঁজবে না যতক্ষণ না বাহা পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাহা পূজার পূর্বে সাঁওতাল কোন মানুষ নতুন ফল খাবে না। সে জন্য অত্যন্ত পবিত্রতার সাথে সাহা পূজা বা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সাহা উৎসবের প্রথম দিন উম অর্থাৎ স্নান বা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিন। উৎসবের মাসাধিক কাল পূর্ব থেকেই সাঁওতালদের ঘরবাড়ি পরিস্কার করার কাজ শুরু করে। মাটি, গোবর এবং খড় পুড়িয়ে রঙ তৈরি করে ঘরদোর সাজিয়ে তোলা হয়। যেকোনো গ্রামে এই রঙ এবং দেওয়ালে বিভিন্ন পশুপাখি, ফুল-পাতা-পাতার চিত্র দেখেই সাঁওতাল পাড়া বা গৃহকে পৃথকভাবে চিনে নিতে একটুও অসুবিধা হয় না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গৃহ বা বাসনকোসন সাঁওতাল সংস্কৃতির অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ।
জাহের থান বা উৎসবস্থলও পরিষ্কার করা হয়। চারিদিকে খড় দিয়ে পাকানো দড়িতে আম পাতা গেঁথে সুন্দরভাবে সাজানো হয়। একটি শাল বা মহুয়া গাছকে ঘিরে ছামডা বা গৃহ তৈরি করা হয়। গোবর দিয়ে নিকানো পূজাস্থল তৈরি হয়। সন্ধ্যায় মোড়ল বা মাঝি থানে নাচ গান হয়। প্রতিটি পরিবারেই মেয়ে জামাইকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়।
মধ্যম দিনে সার্দিমাহা পুজা বা মূল উৎসবের দিন। নায়কে বা পুরোহিতকে পূজাস্থলে নিয়ে আসার জন্য গ্রামের যুবক-যুবতীরা সকালেই স্নান সেরে পুরোহিতের বাড়িতে উপস্থিত হয়। পূজার সামগ্রী নতুন কুলার আতপ চাল, শাল ফুল, মহুয়া ফুল প্রভৃতি নিয়ে প্রস্তুত হলে গ্রামের যুবক-যুবতীগণ নৃত্য ও বাদ্য সহযোগে পুরোহিতকে পূজাস্থলে নিয়ে আসে।
বাহা পরবের পূজা ও অন্যান্য আচার অনুষ্ঠান
শাল ও মহুয়া ফুল এবং নতুন ফুল দেবদেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। সারাদিন ধরে পূজা সমাপ্ত হলে নাচগান শুরু হয় এবং নাচতে নাচতে আবার পুরোহিতকে বাড়িতে পৌঁছায়ে দেয়া হয়। ফিরে যাওয়ার পথে প্রতিটি বাড়ির দরজায় বাড়ির মেয়েরা পুরোহিতের পা ধুইয়ে দেয়। পুরোহিত তার ডাল থেকে প্রতিটি বাড়িতে পূজার নতুন ফুল দেন। বাড়িতে মেয়েরা সেই ফুল বণ্টন করে খোপায় গুঁজে নেয় সম্পর্কিত দেওর, বৌদি বা ননদের মধ্যে জল ছিটিয়ে আনন্দ করতে দেখা যায়। গুরুজনরা অন্য সম্পর্কিত লোকেদের মধ্যে জল ছিটানোর খেলা চলে না। সারা রাত গ্রামে নাচগান আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে।

শেষ দিন উৎসবের জালে মাহা। সেদিনও খাওয়া দাওয়া বা উৎসবের রেশ চলতে থাকে। তিন দিন ধরে বাহা উৎসব সাঁওতাল গ্রামে যুব বৃদ্ধ সবাই মেতে ওঠে। বাহা উৎসবের মধ্য দিয়েই নতুন ফুল ফল ও পাতা ব্যবহার সাঁওতাল সমাজ শুরু করে।
শহরের বাহা উৎসব
ইট পাথরের শহরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের এসব আচার অনুষ্ঠানের সুযোগ নেই বললেই চলে। ফলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা হারাচ্ছে তাদের এই অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। শহরের ইট-পাথরের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের অকৃত্রিম এই ধারা। যান্ত্রিকতার জীবনে আচার অনুষ্ঠান পালনের দিকটি প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে।
জাবিতে বাহা পরব
ইট-পাথরের শহরে যখন আচার অনুষ্ঠান বিলুপ্তির পথে তখনই সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) সংস্কৃতি রক্ষায় আয়োজন করছে বাহা পরব। শিক্ষার্থী-শিক্ষকদেএ উদ্যোগে আয়োজন করা হয় এই বাহা পরবের। এতে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করতে দেখা যায় সাওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষদের।
বাহা বঙ্গা উদযাপন কমিটি ঢাকা এর আহ্বায়ক নিরালা মারডি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এধরনের উৎসবের আয়োজন করার অনুমতি দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ধন্যবাদ। আমাদের প্রতিটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব রীতি-নীতি রয়েছে। আমরা সবসময় সব অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারি না। যদি সবাই আমাদের এভাবে সহায়তা করে তবে আমরা আমাদের প্রধান প্রধান রীতিনীতিগুলো আয়োজন করতে পারব। আমাদের সংস্কৃতিও বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে।
রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কালচারাল একাডেমির পরিচালক হরেন্দ্রনাথ সিং বলেন, ‘বাহা উৎসব সাঁওতালদের নিজস্ব সংস্কৃতির উৎসব। এটি বসন্তকালে হয়ে থাকে। সাঁওতালি ভাষায় বাহা মানে ফুল। বসন্ত ঋতুতে বিশেষ করে শাল গাছে গাছে নতুন ফুল ফুটলে সাঁওতাল সম্প্রদায় এ উৎসব পালন করে। এই অনুষ্ঠানটিতে মূলত সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মঙ্গল ও তাদের জীবিকায় সমৃদ্ধি কামনা করা হয়।’