করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে মারা যাওয়া অর্ধেকই ষাটোর্ধ্ব
বাংলাদেশে ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হার ১০ শতাংশ হলেও এ ভাইরাসে তাদের মারা যাওয়ার হার ৫০ ভাগ।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রোগীর বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা এবং প্রবীণদের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়ার কারণে তাদের মৃত্যুর হার বেশি।
তার পরও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, করোনাভাইরাস বাংলাদেশি প্রবীণদের প্রতি অনেক নমনীয়তা প্রকাশ করছে। কারণ সবচেয়ে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়া দেশগুলোতে এ ভাইরাসের কারণে ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশেরও বেশি।
বিশেষজ্ঞরা ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকার জন্য প্রবীণদের আরো যত্নবান হওয়ার, বাড়ির ভেতরে থাকার, কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব অনুসরণ, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ এবং তাদের চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে আলাপকালে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘করোনাভাইরাসে ষাটোর্ধ্বদের আক্রান্তের হার তুলনামূলকভাবে কম। তবে বয়সজনিত বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা থাকার কারণে এই গ্রুপে মৃত্যুর হার বেশি।’
বয়সের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, গত রোববার পর্যন্ত দেশে মোট দুই হাজার ৪৫৬ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। এর মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ ৬০ বা তার বেশি বয়সের এবং ৬০ শতাংশের বেশির বয়স ২১-৫০ বছরের মধ্যে রয়েছে।
‘কখনো কখনো দেখা যায় যে, ২১-৩০ বছর বয়সী লোকেরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, আবার কখনো কখনো ৩১-৪০ বা ৪১-৫০ বছর বয়সীরা আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে বয়স্ক ব্যক্তিরা সবসময় ১০ থেকে ১১ শতাংশের মধ্যে থাকে, কেননা আমাদের তরুণদের তুলনায় বয়স্ক মানুষ কম।’
মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা উল্লেখ করেন, করোনাভাইরাসজনিত কারণে গত রোববার পর্যন্ত ৯১ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব বয়সীরা কম-বেশি ৫০ শতাংশ মারা গেছেন। এই হার বাংলাদেশের তুলনায় অন্যান্য দেশে অনেক বেশি।’
কোভিড-১৯ আক্রান্ত কম বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে মৃত্যুর হার কম, কারণ তারা তাদের শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে পারেন বলে উল্লেখ করেন আইইডিসিআরের পরিচালক। তিনি আরো বলেন, অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে এ ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে বয়স্কদের অবশ্যই কঠোরভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং বাসা থেকে বের হওয়া উচিত নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপ অফিসের প্রধান ডা. হ্যানস ক্লুজের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা এপি গত ২ এপ্রিল তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইউরোপে করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া ৯৫ শতাংশেরও বেশি লোকের বয়স ৬০ বছরের বেশি।
গত শনিবার প্রকাশিত ভারতীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে কোভিড-১৯-এ মারা যাওয়া ৭৫.৩ শতাংশের বয়স ৬০ বা তারও বেশি।
সরকারি তথ্য অনুসারে, চীনে মারা যাওয়াদের ৮০ শতাংশের বয়স ৬০ বা তার বেশি।
যোগাযোগ করা হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষ বিশেষত যাদের হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা রয়েছে; তাদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, ‘বয়স্ক ব্যক্তিরা অনেক ভাইরাসজনিত রোগ প্রতিরোধ করতে পারে না। একবার তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে আগে থাকা স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি তাদের অবস্থার তীব্র অবনতি ঘটে। ফুসফুস এবং শ্বাসকষ্ট সমস্যাজনিত বয়স্ক ব্যক্তিরা করোনায় মারা যাওয়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা যেমন সাধারণত কম বয়সীদের মতো ততটা শক্তিশালী না, তেমনি বয়স্কদের ওপর করোনাভাইরাস আরো কঠোর।’
বিএসএমএমইউ উপাচার্য বয়স্কদের সবসময় বাড়িতে থাকার এবং সাবান দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়ার পরামর্শ দেন। তিনি আরো বলেন, ‘ফোনে তাদের চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তারা যে রোগে আগে থেকেই ভুগছে তার জন্য নিয়মিত ওষুধ খাওয়া উচিত।’
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (ডিসিএমসিএইচ) মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে প্রবীণদের মারা যাওয়ার হার তরুণদের চেয়ে বেশি। তবে আমরা অন্য অনেক দেশের তুলনায় অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছি। কারণ কোভিড-১৯ রোগীর, যার বয়স ৬০ বছরের বেশি, সেখানে মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশের ওপরে।’
ডা. হারুন আরো বলেন, বয়স্ক ব্যক্তিদের তাদের পরিবারের সদস্যদের থেকেও সচেতন থাকা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে তাদের যতটা সম্ভব মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা উচিত।
মে থেকে জুলাই মাসে বাংলাদেশের বহু প্রবীণ ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়, যা পরে নিউমোনিয়ায় রূপ নেয়। সুতরাং, তাদের এখন নিউমোনিয়ার টিকা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (ডিসিএমসিএইচ) মেডিসিন বিভাগের প্রধান।
‘৬০ বছরের বেশি বয়সীদের গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করা উচিত এবং এসি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা উচিত।। তাদের পুষ্টি এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা উচিত এবং ভিটামিন বি ও সি সমৃদ্ধ ফল এবং শাকসবজি খাওয়া উচিত।। তাদের ভিটামিন ডির জন্য সূর্যের তাপ নেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে পরিবারের সদস্যদেরও বয়স্কদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিত।’
‘তাদের নিজের বাড়ির অভ্যন্তরে হাঁটা উচিত এবং ফিট থাকতে ও উদ্বেগ দূর করতে কিছুটা শারীরিক অনুশীলন করা উচিত।। এটি তাদের নির্বিঘ্ন ঘুমের জন্যও সহায়তা করবে,’ যোগ করেন ডা. রশিদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সাইয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম নুরুন নবী বলেন, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭.৫ শতাংশ (১২.৫ মিলিয়ন) প্রবীণ বা ষাটোর্ধ্ব মানুষ রয়েছে।
‘প্রবীণরা সাধারণত যেকোনো রোগের ঝুঁকিতে থাকে। কারণ তারা তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি ও গুরুতর রোগে ভোগে। বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ রোগীদের মৃত্যুর হার খুব বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ইউরোপের তুলনায় আমরা অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছি কারণ আমাদের মৃত্যুর হার তাদের চেয়ে অনেক নিচে, কারণ আমাদের বেশি বয়স্ক (৭৫ বছরেরও বেশি বয়সী) লোক খুব কমই রয়েছে,’ বলেন অধ্যাপক নুরুন নবী।