করোনার সময় ‘পাগলদের’ জন্য ভালোবাসা
পুরো পৃথিবীর সমস্ত মানুষ যখন জীবনমৃত্যুর সন্ধীক্ষণে দাঁড়িয়ে লড়ছে এক অচিন ভাইরাসের বিরুদ্ধে, সেই কঠিনতম সময়ে প্রতিটি সুস্থ মানুষের অন্য আরেক লড়াইও চলমান ক্ষুধার বিরুদ্ধে। একদিকে ক্ষুধা আর অন্যদিকে মৃত্যুভয়, দুইয়ে মিলে বিপন্ন মানুষের জীবন। এই জীবনযুদ্ধে বিপন্ন অসহায় মানুষ ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে, ভাবার সময় কই প্রতিবেশী, প্রাণী কিংবা অন্যরকম মানুষদের নিয়ে।
কিন্তু ইতিহাস বলে সবাই চিরকাল একই স্রোতে হাঁটে না। প্রতিটি সমাজে, রাষ্ট্রে, জনপদে ভিন্ন স্রোতে হাঁটার মানুষও থাকে। তাদেরই একজন রাঙামাটির সনজিদ কুমার দে। পুরো রাঙামাটির মানুষ, নেতা কিংবা খেঁটে খাওয়া শ্রমিক যখন নিজের জীবন, অন্ন কিংবা ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ে, সেই সময় ছোট্ট আয়ের এই মানুষটি ঠিকই দাঁড়িয়েছেন শহরের ফুটপাতে, পথেঘাটে ঘুরে বেড়ানো পাগলদের জন্য খাবার সংস্থানে। কী আশ্চর্য, নাগরিক ব্যস্ততায় কারোই যে মনেই নেই, মানুষের দেওয়া খাবারে বাঁচা এই মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষগুলো এই কঠিন সময়ে খাবার পাবে কই! নিয়তি ও বাস্তবতা যে তাদের খুঁজে খাওয়ার, নিজেই নিজের খাবার সংস্থানের ব্যবস্থা রুদ্ধ করে দিয়েছে!
কিন্তু ওই যে, যারা কেউ থাকে না, তার জন্য কেউ না কেউ থাকেই। রাঙামাটির পথের মানুষগুলোর জন্য সনজিত নামের এই হস্তশিল্পী প্রতিদিন নিয়ম করে শহর স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে নিজেই খুঁজে খুঁজে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। নিজের বাসায় স্ত্রীর রান্না করার পর সেই খাবার প্যাকেট করে নিজের ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে পুরো শহর ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক পাগলের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন পানিসহ।
অথচ সনজিত নিজেও কিন্তু উচ্চ আয়ের মানুষ নন। রাজন হস্তশিল্প নামে নিজের একটি ছোট্ট প্রতিষ্ঠান আছে। নিজের শিল্পী মনে তৈরি করেন নানান হস্তজাত পণ্য। তারপর সেইসব বিক্রি করেন ঘুরে ঘুরে, শহরের বিভিন্ন দোকানে। ছোট্ট সংসার তাঁর। পুত্র রাজন আর রাজ, সঙ্গে স্ত্রী উষা রাণী দে। রাঙামাটি শহরের গর্জনতলীতে ছোট্ট সংসার তাঁর।
হস্তশিল্পী সনজিত কুমার দে বলেন, ‘আসলে আমি নিজেও এদের ভালোবাসি ছোটবেলা থেকেই। সব সময় চেষ্টা করেছি, এইসব বড় অসহায় বিপন্ন মানুষগুলোর পাশে থাকতে। এবার ২৬ এপ্রিল যখন সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল, তখন হঠাৎ মনে হলো, এই পাগলগুলোর কী হবে? কোথায় খাবার পাবে ওরা? কে খাওয়াবে ওদের? এই চিন্তা থেকেই আমার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে প্রতিদিন বাসায় রান্না করি এবং ১৭/১৮ জন পাগলকে খাবার পৌঁছে দেই। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় ওদের খুঁজে পেতে। সব সময় একই জায়গায় তো আর পাওয়া যায় না। কোথায় কোথায় চলে যায় ওরা...তবু পুরো শহরের তবলছড়ি, রিজার্ভবাজার, কাঁঠালতলী, বনরূপা, ভেদভেদী, কলেজগেইট ঘুরে ঘুরে আমি চেষ্টা করি তাদের খুঁজে বের করে খাবার পৌঁছে দিতে।’’
মানবিক এই কাজে সবার সহযোগিতা চান না সনজিত। তবে কষ্ট হয় খুব, এটা স্বীকার করলেন। ইতোমধ্যেই নিজের জন্য রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) উত্তম কুমার দাশ এবং ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জামালউদ্দিন থেকে ত্রাণ সহায়তা পেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এই সামান্য ত্রাণ দিয়ে বেশি দিন কিছু করা যায় না। কারণ প্রতিদিন ১৭/১৮ জনের রান্না। তবু যখন কেউ এগিয়ে আসে না, আসেনি, তখন তাদের দুজনের এই সহযোগিতাও কম নয়। তবে কারো কাছ থেকে কিছু না পেলেও এই কাজ চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন এই শিল্পী।
সনজিদের এই মানবিক কাজটির ভূয়সী প্রশংসা করে রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের এনডিসি উত্তম কুমার দাশ বলেন, ‘ এইসব বিরুদ্ধ স্রোতের মানুষদের জন্যই পৃথিবী এখনো এতো সুন্দর। মানুষই তো মানুষের পাশে দাঁড়ায়, দাঁড়াবেও। আমি সনজিদের এই কাজটিকে সাধুবাদ জানাই। ওর মতো করে যদি সমাজের সব বিত্তবানরা এগিয়ে আসতো, তাহলে আমাদের অনেক কাজই সহজ হয়ে যেত। আমি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করা শুরু করেছি, এটা অব্যাহত রাখব।’