করোনায় মৃত্যুর পর লাশের কী হবে? চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বৈঠক আজ
করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর পর কোন প্রক্রিয়ায় লাশকে পরিষ্কার করা হবে, কীভাবে দাফন করা হবে, কোন পদ্ধতিতে লাশ কবরস্থান পর্যন্ত নেওয়া হবে তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আজ শনিবারের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এরই মধ্যে একটি খসড়া চূড়ান্ত করেছে। সব ধর্মের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করেছে তারা। তবে আজ আবার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। তারপর খসড়া করা ওই সিদ্ধান্তটিই চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।
নাসিমা সুলতানা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া রোগীদের কীভাবে দাফন করা হবে তা চূড়ান্ত হবে আজ। যদিও আমরা চূড়ান্ত একটি খসড়া তৈরি করেছি। সব ধর্মের মানুষের সঙ্গে কথা বলে দাফনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। আজ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত আকারে সব সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে।’
অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘সব ধর্মের মানুষের ক্ষেত্রে লাশ দাফনের প্রক্রিয়া প্রায় একই হবে। রোগী মারা যাওয়ার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়নে হাসপাতাল থেকেই সব কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে। তবে হিন্দু ধর্মালম্বীদের ক্ষেত্রে লাশ পোড়ানোর কোনো সুযোগ থাকবে না। হিন্দু, মুসলিমসহ অন্য সব ধর্মালম্বীর মৃত লাশকে দাফন করতে হবে।’
নাসিমা সুলতানা বলেন, “হাসপাতাল থেকেই লাশটিকে ‘কেমিক্যালি’ ধোয়া হবে। যারা ধোয়ার কাজ করবেন তারা সর্বোচ্চ প্রটেকশন (সমগ্র শরীর ঢাকা থাকবে) নিয়ে থাকবেন। ধোয়ার সময় সেখানে প্রটেকশন ছাড়া কেউ থাকবেন না। লাশ কেমিক্যালি ধোয়ার পর কাফনের কাপড় পরিধান করানো হবে। কাপড় পরিধানের পর পলিব্যাগ দিয়ে (পলিথিনে মোড়ানো) লাশটি মুড়িয়ে কফিনে রাখা হবে। কাপড় ও পলিথিন দিয়ে মোড়ানোর পর আর কোনোভাবেই লাশটিকে উন্মুক্ত করা হবে না। ধোয়া থেকে শুরু করে কফিনে রাখা পর্যন্ত লাশটিতে স্পর্শ না করার জন্য চেষ্টা চালানো হবে। ধরা-ছোঁয়া ছাড়া যেভাবে করা যায় সেভাবেই করার চেষ্টা করতে বলা হবে। যে লাশটি দাফন করা হয়েছে সেটিও কিন্তু কেমিক্যালি ধুয়ে স্পর্শ ছাড়াই দাফন করা হয়েছে। এখানে কিন্তু গোসল করানোর সুযোগ থাকছে না।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কফিনটি অত্যন্ত সতর্কভাবে রাখা হবে যেন কফিনের পাশেও কেউ যেতে না পারে। এরপর আমাদের লাশবাহী গাড়িতে করে লাশটি কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। কবরে লাশটি কফিনসহ দাফন করা হবে। দাফনের সময়ও লাশটি স্পর্শ করবেন না কেউ। এক কথায় আমরা কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চাই না।’
কোনো বাবা-মা যদি তার সন্তানের লাশটি শেষবারের মতো দেখতে চান, তখন কী করা হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘বাবা-মা বা পরিবারের সম্মতিতেই সব কিছু করা হবে। পরিবারের সম্মতির বাইরে তো যাওয়া হবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, লাশটিকে দেখতে গিয়েও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। ভাইরাসটি খুবই মারাত্মক ও ক্ষতিকর। আর লাশটির শরীরে তো ভাইরাসটির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ থাকবে। সেজন্য লাশ দেখতে দেওয়াটা আসলে মুশকিল।’
হিন্দু ধর্মালম্বীরা তাদের লাশ দাফন না করে পুড়িয়ে ফেলেন। তাদের লাশ দাফন করাটা কী সবাই ভালো চোখে নিবে? এমন প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘লাশ পুড়িয়ে ফেলার কোনো কোনো সুযোগ নেই। কারণ, পুড়িয়ে ফেললে মৃত দেহের শরীরে থাকা ভাইরাসটি বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেটা পরিবেশকে আরো ক্ষতি করবে। সেজন্য সবার সঙ্গে আলোচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘কি ভয়াবহ একটি চিত্র। মা-বাবা তার সন্তানকে কিংবা সন্তান তার মা-বাবাকে শেষবারের মতোও দেখতে পাবে না এ ভয়াবহতা কতদূর পর্যন্ত পৌঁছায় তা আল্লাহ জানে কেবল। সুতরাং যার যার স্থান থেকে সাবধান হোন। এই ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সচেতন হোন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন। নিজেকে বাঁচান, পরিবারকে বাঁচান।’
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ১৮ মার্চ সকালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এক ব্যক্তি মারা যায় বলে জানায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। সেদিন বিকেলে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এসে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা ওই ব্যক্তির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘অতি দুঃখের সঙ্গে বলছি, করোনায় আক্রান্ত একজন মারা গেছেন। আমরা তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। ওই ব্যক্তির বয়স ছিল ৭০ বছরের ওপরে এবং তিনি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ, কিডনিসহ আরো বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন।’
আইইডিসিআর পরিচালক আরো বলেন, ‘এই রোগী একজন ইতালি ফেরত ব্যক্তির মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছিলেন।’
নিজেদের ব্যবস্থাপনায় মৃত ব্যক্তির দাফন সম্পন্ন করা হবে জানিয়ে মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘মৃত ব্যক্তির লাশ প্যাকেট করার আগে আমরাই ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী, গোসল করিয়ে দেব। এরপর কাফনের কাপড় পরিয়ে প্যাকেট করা হবে। সেই প্যাকেট কোনো অবস্থাতেই কেউ খুলতে পারবে না। প্যাকেট খুলে আত্মীয়-স্বজন লাশের মুখ দেখার সুযোগ নেই।’
মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘লাশ প্যাকেট করার পর তা খোলা হলে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে। এতে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। তাই যেভাবে আমরা প্যাকেট করে দিব সেভাবে আমাদের লোক দিয়ে আমাদের ব্যবস্থাপনায় কবর দেওয়া হবে।’
তবে আইইডিসিআর পরিচালক বলেছেন, ‘স্বাভাবিক ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী, একজন মৃত ব্যক্তির জন্য যে ধরনের জানাজার প্রয়োজন হয় তাতে অংশ নিতে কোনো বাধা নেই। লাশ সামনে রেখে জানাজা পড়া যাবে এবং তাতে অংশ নেওয়া যাবে।’
করোনাভাইরাসে মৃত ওই ব্যক্তির লাশ সেদিন রাতে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে নিয়ে বিশেষ সতর্কতায় দাফন করা হয়। আঞ্জুমান আসকারী ও আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম লাশের দাফনের ব্যবস্থা করে। ওই ব্যক্তির দাফন-কাফনে তাঁর স্বজনদের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। জানাজা একা পড়ান নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী। ঢাকা জেলা প্রশাসনের একজন ম্যাজিস্ট্রেট দূর থেকে তদারকি করেন।