করোনা মোকাবিলায় জয়পুরহাট মডেল
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2020/05/19/joypurhat.jpg)
উত্তরবঙ্গের ছোট্ট জেলা জয়পুরহাটে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৮৬ জন। এরই মধ্যে ২৯ জন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন, তাদের মধ্যে দুজন শিশু আছে। মাত্র ৫ উপজেলার এই জেলায় ১৩ মে পর্যন্ত ৩ হাজার ৬৮৫ জন সন্দেহভাজন ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ১৪৬টি স্যাম্পল দেশের বিভিন্ন পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষা হয়েছে।
নমুনা প্রদানের জন্য কোনো রোগীকে কোথাও গিয়ে লাইন ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়নি। বরং কালেকশন বুথ তৈরি করে নমুনা সংগ্রহ হয়েছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে প্রতি ইউনিয়নের তিনটি করে স্থানে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘টেস্ট, টেস্ট অ্যান্ড টেস্ট’ নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে এই জেলায় করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে অনেক বেশি এবং মানসম্মত সেবার কারণে এরই মধ্যে ২৯ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। সুস্থতার হারের দিকেও জয়পুরহাট সবচেয়ে অগ্রগামী। বাংলাদেশের অন্য সব জেলা থেকে এই জেলার করোনা মোকাবিলা পদ্ধতি ভিন্নতর। এখানে জেলা আধুনিক হাসপাতাল ও চারটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নবনির্মিত ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি ক্যাম্পাসে একটি আইসোলেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ, জনপ্রশাসন ও সমাজসেবীদের যৌথ উদ্যোগে এই সেন্টারটি পরিচালিত হচ্ছে। আইসোলেশন সেন্টারটি জেলা শহর থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে আক্কেলপুর উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। পালাক্রমে আটজন চিকিৎসক সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপি সার্বক্ষণিকভাবে সেন্টারটির সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি দেশের অপরাপর হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে যেসব অসুবিধা বা ঘাটতি মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে, তাৎক্ষণিক সেসব সমস্যা এই কেন্দ্রে হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে চিকিৎসক ও রোগীদের কাছ থেকে একাধিক সোর্সে খবর নিয়ে তা সমাধান করছেন। ফলে প্রথাগত চিকিৎসার পাশাপাশি গরম পানির ভাপ নেওয়া, ওয়াই ফাই সংযোগ দিয়ে বহিরাঙ্গণের সঙ্গে যোগাযোগ ও বিনোদনসহ রোগীদের মানসিক শক্তি যোগানো হচ্ছে।
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2020/05/19/joypurhat1.jpg 687w)
এ ছাড়াও জেলা শহরের সন্নিকটে টিটিসিতে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে এবং কালাই সরকারি মহিলা কলেজ ও পাঁচবিবি মহিলা কলেজকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলায় হোম কোয়ারেন্টিন না মানা সন্দেহজনক শতাধিক ব্যক্তিকে এরই মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রেখে তাদের টেস্ট করানো হয়েছে। এই প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকা অন্য জেলা থেকে আসা ১৬ জন ব্যক্তির করোনা ধরা পড়েছে।
আইসোলেশন সেন্টার ও কোয়ারেন্টিন সেন্টারের সিংহভাগ ব্যয়ভার হুইপ নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দিচ্ছেন। তবে, গত ১ মে থেকে আইসোলেশন সেন্টারের শুধু রোগীদের খাবার স্বাস্থ্য বিভাগ এবং কোয়ারেন্টিন সেন্টারে খাবারের চাল জেলা প্রশাসন এবং ইফতারি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সরবরাহ করছে।
করোনা চিকিৎসার পাশাপাশি জেলার সব সরকারি হাসপাতালে স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। ইতিমধ্যে জেলার ৩২টি ইউনিয়নের মধ্যে ২৪টি ইউনিয়নে সরকারি চিকিৎসকদের উপস্থিতিতে হেলথ ক্যাম্প করে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে জেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়কসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনবহুল স্থানগুলোতে ব্লিচিং পাউডার মিশ্রিত পানি ছিটানো হয়েছে।
স্বতন্ত্র আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন করায় জেলার সব হাসপাতাল এবং ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীর ঝুঁকির মাত্রা অনেক কমে এসেছে। করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র আইসোলেশন সেন্টার ও নমুনা সংগ্রহের এই জয়পুরহাট মডেল সর্বত্র চালু করতে পারলে স্বাস্থ্য কর্মীদের ঝুঁকির মাত্রা ৮০ ভাগ কমে আসবে এবং সংকটের সময় স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য জনবল সংকট হবে না। এই জেলায় কর্মরত ৯৪ জন চিকিৎসকের মধ্যে মাত্র আটজন চিকিৎসক আইসোলেশন সেন্টারে সরাসরি করোনা পজিটিভ রোগীর স্বাস্থ্যসেবার ঝুঁকি বহন করছেন এবং সর্বোচ্চ ১০ জন চিকিৎসক নমুনা সংগ্রহের ঝুঁকি বহন করছেন। ফলে ১৯ শতাংশ ডাক্তার ছাড়া বাকি ৮১ শতাংশ চিকিৎসককে করোনা রোগী হ্যান্ডেল করতে হচ্ছে না, ফলে তাদের ঝুঁকির মাত্রাও কম।
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2020/05/19/joypurhat2.jpg 687w)
এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে শুধু সমস্যার গভীরে প্রবেশ, সমন্বয় ও টিমওয়ার্ক। এখানে রাজনীতিবিদ, সিভিল প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ ও স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বিত টিম ওয়ার্ক। গত ২২ মার্চ করোনা প্রস্তুতির শুরুতে জাতীয় সংসদের হুইপ ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপি বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলা সফর করেন। তিনি দুটি জেলার সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুটি সভা করেন ও পাঁচটি হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। উক্ত সভা দুটিতে উপস্থিত জনপ্রতিনিধি, চিকিৎসক, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার সবাই আলোচনা করে বগুড়ায় মোহম্মদ আলী হাসপাতাল ও জয়পুরহাটে আইএইচটিকে বিশেষায়িত আইসোলেশন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। বগুড়ার মোহম্মদ আলী হাসপাতাল একটি প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল হওয়ায় সেটি চালু করতে কোনো চ্যালেঞ্জ পোহাতে হয়নি। কিন্তু জয়পুরহাটের আইএইচটি কোনো হাসপাতাল নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নবনির্মিত, কোনো ফ্যাসিলিটিজ নেই। হুইপ স্বপনের প্রচেষ্টা ও অর্থায়নে জেলার প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং রাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবকদের যৌথ উদ্যোগে দ্রুত এটি কার্যউপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। ভেন্টিলেশন, আইসিইউ বা আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি এখানে নেই। কেবল কিছু চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কর্মী, কিছু অক্সিমিটার, অক্সিজেন সিলিন্ডার ও একান্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে চলা এই আইসোলেশনে সেন্টার ৮৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন এবং ২৯ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। আরো কয়েকজন তৃতীয় স্যাম্পলের টেস্টের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছেন। সুস্থ হওয়ার দিক থেকেও এই ছোট উদ্যোগ শতকরা হারে দেশে সর্বোচ্চ।