কুয়েট শিক্ষার্থীর মৃত্যু নিয়ে ‘বিভ্রান্তিকর’ তথ্যে কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী অন্তু রায়ের মৃত্যু নিয়ে মুখ খুলল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালে ‘বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে’ উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে কুয়েট কর্তৃপক্ষ। বলা হয়, অন্তু রায়ের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওনা মাত্র ছয় হাজার ৬৫৫ টাকা, যা নিয়ে তাঁকে কখনোই চাপ দেওয়া হয়নি।
ওই সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে—খাওয়া বাবদ অন্তুর কোনো বকেয়া নেই। ‘নন বোর্ডার’ বলে তথ্য ছড়ানো হয়েছে, তাও মিথ্যা। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত হল ভর্তি ও সিট বরাদ্দ বাবদ অন্তুর বকেয়া ছিল মাত্র ছয় হাজার ৬৫৫ টাকা। এ ছাড়া হলের পক্ষ থেকে সে টাকা পরিশোধের জন্যও কোনো চাপ প্রয়োগ করা হয়নি। বরং, তাঁর পারিবারিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্রুতই অন্তুকে হলে থাকার ব্যবস্থাও করেছিল।
এর একদিন আগে গতকাল বৃহস্পতিবার এনটিভি অনলাইন ‘সাড়ে ছয় হাজার টাকার সংকটে কি ফুরাল কুয়েট শিক্ষার্থীর প্রাণ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, ‘গত সোমবার না ফেরার দেশে পাড়ি জমান খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী অন্তু রায় (২১)। অর্থের সংকট, না কি অন্য কোনো কারণ ছিল এ মৃত্যুর পেছনে, তা এখন শুধুই রহস্য।’
অন্তু রায়ের মৃত্যুর পেছনে অভাবকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে নানা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেও, তা মানতে নারাজ তাঁর মা, বাবা, স্বজন ও প্রতিবেশীরা।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তুর টেক্সটাইল বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী হাসিবের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের দেওয়া স্ট্যাটাসে দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ১৮ হাজার টাকা বকেয়া সংকটে এ আত্মহত্যা। তবে, অন্তুর বন্ধু ফুয়াদের দাবি, হলে বাকি ছিল সাড়ে ছয় হাজার টাকা। এ বিষয়ে পরিবার বলছে, তিন হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল, যা মৃত্যুর পরও অন্তুর ব্যাগে পাওয়া গেছে। সেখানে অন্তুর জমানো টাকাও ছিল। সব মিলিয়ে স্বজন ও প্রতিবেশীরা বলছেন—বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।’
এরপর আজ শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন থেকে উঠে এলো কুয়েটে অন্তুর বকেয়া নিয়ে তথ্যের আসল দৃশ্য।
‘বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে’ উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে কুয়েটের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘মিথ্যা তথ্যে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’
রবিউল ইসলাম জানান, অন্তু কখনও হলে ডাইনিং ব্যবহার করেনি। ফলে তাঁর খাওয়া বাবদ কোন বকেয়া নেই এবং এজন্য তাঁকে ‘নন বোর্ডার’ করার কোনো বিষয় নেই।
জনসংযোগ কর্মকর্তা আরও জানান, হলের বকেয়া টাকার সঙ্গে সেন্ট্রাল ভাইভার কোনো সম্পর্ক নেই। অন্তু রায় দ্বিতীয় বর্ষে সব পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু, সেন্ট্রাল ভাইভাতে অংশ নেননি এবং এর কোনো কারণও এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
জনসংযোগ কর্মকর্তা রবিউলের দাবি, ‘একটি পক্ষ মিথ্যা তথ্য প্রচার করে কৌশলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টা করছে।’
এদিকে, গত সোমবার খুলনার ডুমুরিয়ায় নিজ বাসায় অন্তু রায়ের (২১) আত্মহত্যার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে হাসিব আহমেদ নামের একজন লেখেন, ‘...অন্তু রায় ছেলেটা ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসে ছিল প্রচুর। সাথে সাথে ফ্যামিলির ইন্টার্নাল সমস্যা ছিল প্রচুর। এই ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসের মধ্যে প্রচুর হল ডিউজ আসছিল তার (প্রায় ১৮ হাজার+)। রশীদ হলের বর্ডার ছিল সে। টেক্সটাইল ১৮ ব্যাচের সবাই এই টাকা ম্যানেজও করে ফেলছিল। আর আজকে সকালে সে সুইসাইড করে।’
হাসিব ওই স্ট্যাটাসে আরও লেখেন, ‘আসলে বাকরুদ্ধ হয়ে আছি। কিছু বলার নাই। কী বলব। নিজ ডিপার্টমেন্টের ছোট ভাই এভাবে সুইসাইড করল।’
বিশেষ দ্রষ্টব্যে হাসিব লেখেন, ‘ছেলেটা এবারের সেন্ট্রাল ভাইবা দেয়নি। আজকে তার হলে ওঠার কথা ছিল।’
হাসিবের এই স্ট্যাটাসের পর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এমনই সব তথ্য উঠে আসতে দেখা যায়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের একই কক্ষে থাকা অন্তুর বন্ধু ফুয়াদুজ্জামান গতকাল বৃহস্পতিবার জানান, হলে সাড়ে ছয় হাজার টাকা বাকি ছিল অন্তুর। অনেকেরই অনেক টাকা বাকি আছে। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন না অন্তু। তাঁর কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল বলেও শোনেননি ফুয়াদ। তিনি বলেন, ‘এমন অবস্থায় কীভাবে আত্মহত্যা করতে পারে সে, ভাবতে পারছি না।’
এলাকার সবার কাছে মেধাবী, মিষ্টভাষী, ভালো ছেলে বলে পরিচিত অন্তুর আত্মহত্যায় পাগলপ্রায় তাঁর মা-বাবা ও বোন। আর্থিক সংকটের কারণে অন্তুর মৃত্যু হয়েছে বলে মেনে নিতে পারছেন না প্রতিবেশী, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, গুটুদিয়া ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরাও।
গুটুদিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা সরোয়ার বলেন, ‘অন্তু সবার কাছেই প্রিয় ছিল। ওর চলে যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না। শুধুই আর্থিক সংকটের কারণে ওর মৃত্যু হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না, তা উদ্ঘাটন করা উচিত বলে আমি মনে করি।’
তবে, গুটুদিয়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান তুহিনুল ইসলাম তুহিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘অতিদরিদ্র ঘরের অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল অন্তু। আপাতত অর্থনৈতিক সংকটকেই আত্মহত্যার কারণ বলে মনে হচ্ছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তুহিনুল ইসলাম বলেন, ‘তাঁর অর্থনৈতিক সংকটের কথা আমাকে কখনোই জানানো হয়নি। এত মেধাবী একজন শিক্ষার্থী ঝরে পড়ায় আমরা ইউনিয়নবাসী মর্মাহত।’
অন্তুর দাদা অসীম বলেন, ‘ওর বন্ধুদের কাছে জেনেছিলাম, অন্তু মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বের হলেও পরীক্ষা দেয়নি। হলে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ওর সাড়ে ছয় হাজার টাকা বকেয়া ছিল।’
অন্তুর মৃত্যুর দিন তাঁর মা বলেছিলেন, ‘কিছু টাকা লাগবে বলে জানিয়েছিল। তিন হাজার টাকা দিয়েছিলাম। আর দিতে পারিনি।’
অন্তুর বাবা দেবব্রত রায় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাকে বলেছিল, নতুন সেমিস্টারে ভর্তির জন্য দুই হাজার ৮০০ টাকা লাগবে। আর, হলে কিছু বাকি আছে। সেটা পরে দিলেও চলবে। আমরা ওকে তিন হাজার টাকা দিয়েছিলাম। সে টাকা ওর ব্যাগে পেয়েছি। সঙ্গে ওর জমানো কিছু টাকাও ব্যাগে ছিল।’
অন্তুর আত্মহত্যার বিষয়ে জানতে চাইলে ডুমুরিয়া থানার ওসি ওবায়দুর রহমান সেদিন জানান, সোমবার নিজ ঘরের আড়ার সঙ্গে ধুতি পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় অন্তুকে দেখতে পান তাঁর চাচা। সকাল সাড়ে ৮ টার দিকে তাঁর মা-বাবা পরের খেতে কাজ করতে গিয়েছিলেন। ১০টার দিকে তাঁর বোন স্কুলে যায়। এরপর অন্তু একা ঘরে এমনটা করতে পারেন।
অন্তুর চাচা দেখতে পেয়ে সবার সহযোগিতায় তাঁকে উদ্ধার করে ডুমুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
ওসি বলেন, ‘প্রাথমিক ভাবে জানতে পেরেছি, অন্তু রায়ের পরিবার খুবই দরিদ্র। তিনি মা-বাবা কাছে পড়ালেখার খরচের জন্য কিছু টাকা চেয়েছিলেন এবং তাঁর মা তাঁকে তিন হাজার টাকাও দিয়েছিলেন। কিন্তু আবার সে ফিরে আসে।’
ওসি ওবায়দুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এ ঘটনায় নিহতের চাচা বাদি হয়ে ডুমুরিয়া থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেছেন।’