কৃষকদের বরেন্দ্র ভবন ঘেরাও, প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি
রাজশাহীতে সেচের পানি না পেয়ে দুই সাঁওতাল কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবিতে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। আর গভীর নলকূপ পরিচালনায় অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের প্রতিকার চেয়ে বরেন্দ্র ভবন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পাঁচ শতাধিক কৃষক।
দুই সাঁওতাল কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনার প্রতিবাদের অংশ হিসেবে আজ সোমবার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সামাজিক সংগঠন জাতীয় রক্ষাগোলা সমন্বয় কমিটি এই কর্মসূচি পালন করে।
আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জাতীয় রক্ষগোলা সমন্বয় কমিটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনের সড়কে মানববন্ধন করে। ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন শেষে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একটি প্রতিনিধিদল জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেয়। স্মারকলিপিতে রক্ষগোলা সমন্বয় কমিটির সভাপতি সরল এক্কা, উপদেষ্টা প্রসেন এক্কা, সিসিবিভিওর প্রতিনিধি আরিফুর রহমান, মৃত কৃষক অভিনাথ মার্ডির স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম, মৃত রবি মার্ডির বড় ভাই সুশীল মার্ডি ও রক্ষগোলা সমন্বয় কমিটির সদস্য রঞ্জিত সাওরিয়ার স্বাক্ষর রয়েছে।
পরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পাঁচ শতাধিক নারী-পুরুষ পদযাত্রা নিয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) প্রধান কার্যালয় ঘেরাও করতে যায়। ঘণ্টাব্যাপী বরেন্দ্র ভবন ঘেরাওকালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একটি প্রতিনিধিদল বিএমডিএ চেয়ারম্যান বেগম আকতার জাহান ও নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশিদের অনুপস্থিতিতে সচিব ইকবাল হোসেনের সঙ্গে দেখা করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর দেওয়া স্মারকলিপির কপি হস্তান্তর করেন।
স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, গত ২৩ মার্চ বিকেলে গোদাগাড়ী উপজেলার নিমঘুটু সাঁওতাল পল্লীর অভিনাথ মার্ডি ও রবি মার্ডি ধানের জমিতে সেচের পানি না পেয়ে এবং বিএমডির গভীর নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের অসদাচারণের শিকার হয়ে বিষপান করেন। ওই দিনই অভিনাথ মার্ডি মারা যান। তার চাচাতো ভাই রবি মার্ডি ২৫ মার্চ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হৃসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ঘটনার পর পরই সাখাওয়াত হোসেনের নামে গোদাগাড়ী থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গেলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের অসহযোগিতা ও অবহেলার কারণে ঘটনার দুদিন পর মামলা হয়।
স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, গভীর নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই সেচের পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ থাকলেও বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। গভীর নলকূপের আওতাধীন চাষযোগ্য জমির অর্ধেক কৃষক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর হওয়া সত্ত্বেও তিনি বরাবরই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কৃষকদের দেরিতে সেচের পানি দেন।
এর আগে সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে ২০২০ এবং ২০২১ সালে স্থানীয় কৃষকরা বিএমডিএর কাছে লিখিত অভিযোগ করলেও কর্তৃপক্ষ সেই অভিযোগ আমলে নেয়নি। বিএমডিএর কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও অসৎ নলকূপ অপারেটররা মিলে বরেন্দ্র অঞ্চলে একটি পানি মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করেছে, যার শিকার লাখ লাখ অসহায় কৃষক।
প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠানো স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দুই কৃষকের আত্মহননের পেছনে সাখাওয়াত হোসেনের মতো জাতিবিদ্বেষী দুর্নীতিবাজ অপারেটর যেমন দায়ী, ঠিক তেমনি এই বরেন্দ্র অঞ্চলের কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থা বিএমডিএর অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম সমানরূপে দায়ী। দুই কৃষকের আত্মহত্যার পর খোদ কৃষি মন্ত্রণালয়ের তদন্তে উঠে এসেছে, সাখাওয়াত হোসেন বিএমডিএ কর্তৃক নির্ধারিত ১২৫ টাকা ঘণ্টার পানি ১৩৫ টাকায় কৃষকদের কাছে বিক্রি করতেন। এই অনিয়ম বহুদিন ধরে চলমান থাকলেও কর্তৃপক্ষের কোনো তদারকি ছিল না।
স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়েছে, গোটা বরেন্দ্র অঞ্চলের সেচের পানি গভীর নলকূপ অপারেটরদের কবজায়। তাদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে প্রায় চার লাখ কৃষক। নলকূপ অপারেটর নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বিএমডিএ স্বার্থবাদী চক্র ও দলীয় সমর্থন বিবেচনায় রাখে। যার ফলে নলকূপগুলোর পানি বণ্টন নীতি দলীয় নেতাকর্মীদের স্বেচ্ছাচারিতার অংশ হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে এসব অসৎ নলকূপ অপারেটররা যে ক্ষমতাসীন দলের নামের অপব্যবহার করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠানো স্মারকলিপিতে যেসব দাবি জানানো হয়েছে, সেগুলো হলো—অভিনাথ মার্ডি ও রবি মার্ডির আত্মহত্যায় প্ররোচনা প্রদানকারী সাখাওয়াত হোসেনকে বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচ কার্যক্রমের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের জন্য বিএমডিএ কর্তৃপক্ষকে তদন্তের আওতায় এনে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বরেন্দ্র অঞ্চলে গভীর নলকূপ পরিচালনার ক্ষেত্রে কৃষকবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং সুষ্ঠু তদারকির বিধান রাখতে হবে। ক্ষুন্দ্র নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে অপারেটর হিসেবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ও প্রাপ্তিক কৃষকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ও প্রান্তিক কৃষকদের পর্যাপ্ত পরিমাণে সেচের পানির অভিগম্যতার সুযোগ নিশ্চিতকল্পে নীতিমালায় সুস্পষ্ট বিধান থাকতে হবে।
এদিকে, দুই সাঁওতাল কৃষকের আত্মহত্যার পর গ্রেপ্তার বিএমডিএর গভীর নলকূপের চাকরিচ্যুত অপারেটর সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, ওই দুই কৃষক তাঁর নলকূপের সামনে আত্মহত্যা করেননি। কারাফটকে করা জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে এ কথা বলেন তিনি। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান বলছে, নিজের নলকূপের সামনে থেকে অভিনাথের মরদেহ ভ্যানে করে সাখাওয়াতই বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন।
গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম বলেন, সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে হওয়া আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা দুটি তদন্ত করছেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাহাফুজুল হক। আসামিকে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদে আদালতের অনুমতি পেয়ে তিনি দুদিন তাঁকে জেরা করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদে সাখাওয়াত দাবি করেন, কৃষক অভিনাথ মার্ডি ও তার চাচাতো ভাই রবি মার্ডি কোথায় বিষপান করেছেন, তা তিনি জানেন না। যদিও ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় কৃষি মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিকে স্থানীয় এক ভ্যানচালক বলেছিলেন, গভীর নলকূপের সামনেই বিষপান করেন অভিনাথ। তখন অপারেটর সাখাওয়াতই তাকে ভ্যান নিয়ে যেতে তাকে ডাকেন। এর পর তারা দুজন মিলে অভিনাথকে নলকূপের সামনে থেকে ভ্যানে তুলে তার বাড়িতে এনে নামিয়ে দেন। আর রবি একাই নলকূপের সামনে থেকে হেঁটে বাড়ি এসেছিলেন বলে তদন্ত কমিটিকে জানান তার ভাই সুশীল মার্ডি।
তবে বিএমডিএর গভীর নলকূপ থেকে কৃষকদের পানি বণ্টনে অনিয়ম, সিরিয়াল না মানা, স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগের বিষয়ে সাখাওয়াত তদন্ত কর্মকর্তাকে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
তদন্ত কর্মকর্তা সাখাওয়াতের কাছে জানতে চেয়েছিলেন পানি কোন কৃষককে কত দিন পর দেওয়া হচ্ছে, তা খাতায় লেখা হয় কি না এবং একজন কৃষককে যে সিরিয়াল অনুযায়ীই পানি দেওয়া হয়েছে, তার নিশ্চয়তা কী?
জবাবে সাখাওয়াত বলেন, ‘খাতায় কিছু লিখিত নেই।’ আর সিরিয়াল কীভাবে নিশ্চিত করা হয়, সে বিষয়ে সাখাওয়াত কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
ওসি জানান, ঘটনা তদন্তে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি সরেজমিনে এলে বিএমডিএ কর্মকর্তারা জানান, ২১৩ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষের জন্য ওই গভীর নলকূপ। বাস্তবে চাষ হয়েছে ২৬৫ বিঘা। সাখাওয়াত ও বিএমডিএর হিসাব কেন মিলছে না, সে প্রশ্নেরও সদুত্তর দিতে পারেননি চাকরিচ্যুত অপারেটর সাখাওয়াত হোসেন।