ছেলের জন্মদিনের উপহার নিয়ে যাওয়া হলো না মোমেনুরের
সাংবাদিক মোমেনুর ইসলাম মণ্ডল, ডাক নাম মোমেন স্বপন। গান ও নাটক লিখতেন। আঁকতেন ছবিও। থাকতেন রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায়। তাঁর পরিবার থাকে বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায়। গত বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে মুঠোফোনে মোমেনুর তাঁর স্ত্রীকে বলেন, ‘বড়বেটার জন্মদিন আজ, কী খাবে; সব রান্ধে (রান্না) দাও।’
এ কথা জানিয়ে মোমেনুরের স্ত্রী তানজিলা আক্তার বলেন, ‘‘বেটার বাবার এ কথা শুনে আমি কলাম, আচ্ছা, সব রেন্ধে দেবনি। তখন মোমেন বলে, ‘শুনে ভালো লাগল। নতুন কি কাপড় লিবে, এনে দাও। সব করে দিবা তো?’ তখন আমি খুশি হয়ে কলাম, ‘রেন্ধে দিব; তুমি রোববার বাড়ি এসে সবকিছু কিনে দিও।’’
‘‘এসময় মোমেন আমাকে বলল, ‘পোলাও রান্ধে খাওয়াও। মেলা করে রানবা। ছেলের জন্মদিনের রান্ধা টেস্ট হবে না কি হবে না, আমি চেক করব। আমার জন্যও রাখি দিবা। আমি রোববার সকালে গিয়ে খাব।’ এরপর আমি এক হাড়ি পোলাও রান্ধে রাখলাম, ছেলেদের খাওয়ালাম। এই রাখা খাবার এখন আমি কীভাবে খাবো?’’ বিলাপ করতে করতে বলছিলেন তানজিলা।
‘তখন আমি বড়বেটাকে (মারজান মাহমুদ টুটুল) কলাম, তোর বাবা উপহার নিয়ে আসপেনে রোববার। মেলা জিনিস কিনে দিবেনে। এ কথা শুনে আমার বড়বেটা মেলা খুশি হয়।’
গতকাল শুক্রবার সকাল ৭টা ১০ মিনিটে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) মোমেনুর ইসলাম মণ্ডল স্বপন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। অশ্রুসিক্ত ছিলেন বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মীরা।
সাংবাদিক মোমেনুর ইসলাম এনটিভি অনলাইনের সিনিয়র নিউজরুম এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সহকর্মীদের সঙ্গে প্রাণখোলা হাসি নিয়ে কথা বলতেন, বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়াতেন। কিন্তু, নিজের দুঃখ-কষ্টের কথা কখনও কাউকে বলতেন না। অন্তর্মুখী অথচ সদালাপী মোমিন ছিলেন সবার প্রিয়ভাজন। মারা যাওয়ার আগের বুধবার রাতেও সুস্থ শরীরে তিনি অফিস থেকে বের হয়ে বাসায় যান।
পরদিন সকালে অর্থাৎ বৃহস্পতিবার স্ট্রোকের কিছুক্ষণ আগে মুঠোফোনে ফোনে কথা বলেছিলেন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে। হাসপাতালে বসে সেই শেষ স্মৃতির কথা বলছিলেন তানজিলা।
স্ট্রোকের পর মোমেনুর ইসলামকে রাজধানীর তিনটি হাসপাতালে ঘুরিয়ে বিকেল পৌনে ৫টার দিকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মোমেনুরের স্ত্রী তানজিলা আক্তার নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের দশ তলার আইসিইউর সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছিলেন। এ দৃশ্য দেখে তাঁকে হাসপাতালের নিচে নামাতে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের দাবি, আইসিইউ ফ্লোরে এভাবে কাঁদলে অন্য রোগীদের অসুবিধা হতে পারে। এরপর তানজিলাকে পাজাকোলে করে নিচে নামানো হয়। তখনও হাসপাতালের নিচে বসেই বিলাপ করছিলেন তিনি। সেখানে এ প্রতিবেদক উপস্থিত ছিলেন।
তানজিলা আক্তার আরও বলেন, ‘‘মোমেন যখন ফোন দেয়, প্রথমেই আমি কলাম, তোমার বেটাকে নিয়ে তো আর পারি না। প্রায়ভেট থেকে আজও দেরি করি আইছে। তখন মোমেনুর বলে, ‘বেটাকে গালায়ো না। কিছু কয়ো না। মেরে না। দেরি করে আনন্দ করে ফিরেছে, আসুক। তোমরা আনন্দ করে থাকো। দুই বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করো। মনে করো, আমি পাশে আছি। লেখা পড়া করায়ো ভালো করে। লেখাপড়া ছাড়া আর কিছুই নেই। লেখাপড়াই আমাদের সম্পদ।’ আমি বলি, আচ্ছা। কিছু কবো না।’’
মোমেনুরের বড় ছেলে মারজান মাহমুদ টুটুল আক্কেলপুর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণিতে পড়ে। ১৩ বছর শেষ করে গত বৃহস্পতিবার ১৪ বছরে পা দিয়েছে টুটুল। গ্রামে বাবা মোমেনুরের তৈরি বাড়িতে আর কেউ না থাকায় তানজিলা তাকে রেখে ঢাকায় এসেছেন। মোমেনুরের ছোট ছেলের নাম মুনতাসির মাহমুদ তামিম। তামিমের বয়স তিন বছর।
একা একা তানজিলা বলতে থাকেন, ‘আমার ছোটবেটা তামিম গত বুধবার রাত ৯টার সময় বুকের ওপর খেলিচ্ছে আর কচ্ছে, ওমা তুমি বাবা, তুমিই আমার মা। আমার বাবা নেই। আমি তাও বুঝতে পারিনি। আমার ছোটবেটা বুঝতে পেরেছে।’
তামিমকে কোলে নিয়ে তার মাথায় হাত বুলাচ্ছিলেন মা। তখন তানজিলা বলছিলেন, ‘‘মরার খবর শোনার আগে তামিমকে ভাত খাওয়াচ্ছিলাম। সে সময় ছেলে তিনবার বলে উঠেছিল, ‘মা বাবা নেই।’ তার কিছুক্ষণ পরেই হাসপাতালের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়, আমার সোনা (মোমেনুর) আর নেই।’’
এসব কথা বলতে বলতে তানজিলা আক্তার কখনও উচ্চস্বরে, কখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। কখনও-বা মাথা ঘুরে পড়ে যান। দু’তিনবার তাঁকে পাঁজাকোলে করে বসিয়ে দেওয়ার পর আবারও তিনি বিলাপ করতে থাকেন। এ দৃশ্য দেখে আশাপাশে থাকা পরিচিত কিংবা অপরিচিতজন চোখ মুছতে থাকেন সময়ে সময়ে।
তানজিলার দাবি, তাঁর স্বামী মোমেনুর ইসলাম মণ্ডল স্বপন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বামী। অর্থ কষ্ট থাকলেও মোমেনুর পরিবারের খোঁজ নিতেন বারবার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। কখনো কারও ক্ষতি করতেন না। অর্থকষ্ট থাকলেও মোমেনুর কারও কাছে এক টাকাও ঋণ নেই। এসব কথা জানাতে জানাতে পুনরায় শেষবারের কথোপকথনের প্রসঙ্গ তুললেন তানজিলা আক্তার।
তানজিলা বললেন, ‘‘মোমেন শেষবার ফোন রাখার সময় বলল, ‘নেও, এখন রাখছি। অফিস যেয়ে নামাজ পড়ে আবার ফোন দিবুনি।’ তখন আমি কলাম, তুমি আইতাল কুসরি পড়ে বের হয়ো। আমাদের ওপর আল্লাহ আছেন। এই এক মাস হল, বেশি বেশি ফোন দেয় মোমেন। রাত ১২টা, একটা নেই; সারাক্ষণই ফোন দেয়। ১০ মিনিট পর পর ফোন দেয়। এখন আমাকে কে ফোন দেবে?’’
‘‘আমাকে মোমেন বলেছিল, শুক্কুরবারে অফিসে জানাবে ছুটির নেওয়ার কথা। শনিবার অফিস করে রাতেই বাড়ি চলি আসপে। রোববার তাঁর ছুটি। আর সেই শুক্কুরবারেই লাশ হয়ে বাড়ি যাচ্ছে আমার টুটুলের বাপ। আমার খোঁজ নেওয়ার মতো আর কেউ থাকল না’’ যোগ করেন তানজিলা আক্তার।
সহকর্মীদের শেষ শ্রদ্ধা
নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল থেকে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে মোমিনুর ইসলামের লাশ কাওরান বাজারে এনটিভি কার্যালয়ের সামনে আনা হয়। সেখানে তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার পর তাঁকে শেষবারের মতো বিদায় জানান তাঁর অশ্রুসিক্ত সহকর্মীরা।
জানাজায় এনটিভির পরিচালক নুরুদ্দীন আহমেদ, এনটিভি অনলাইনের সম্পাদক খন্দকার ফকরউদ্দীন আহমেদ ও তাঁর সহকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মোমেনের স্বজনরা জানাজায় অংশ নেন। এরপর আজ সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনেটে দ্বিতীয় জানাজা শেষে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার বেড়িনজো গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।