ছয় মাসেও শাস্তির আওতায় আসেনি মর্জিনাকে এসিড নিক্ষেপকারীরা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলায় ছয় মাস আগে দুর্বৃত্তদের ছোড়া এসিডে ঝলসে যায় গৃহবধূ মর্জিনার শরীর। ঘটনার ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও শাস্তির আওতায় আসেনি দুর্বৃত্তরা।
এসিডে দগ্ধ মর্জিনা ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে চার মাস চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে ফিরলেও হারিয়েছেন তাঁর সুন্দর চেহারা। গলা ও বুকের পোড়া চামড়ায় টান পড়ায় মাথা সোজা করতে পারেন না তিনি। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেও পারেন না। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝড়ছে। শরীরের যন্ত্রণায় কাতরালেও অর্থাভাবে আর চিকিৎসা নিতে পারছেন না তিনি।
এ ঘটনায় স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের কারসাজিতে থানায় মামলা করতে না পেরে ঘটনার এক মাস পর গৃহবধূর স্বামী বাদী হয়ে আদালতে মামলা করেন। বিজ্ঞ আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন।
এদিকে মামলার কারণে আরও তোপের মুখে পড়েছে এসিডদগ্ধ মর্জিনার পরিবার। অভিযুক্ত ও প্রভাবশালীদের ভয়ে স্বামী ও সন্তান নিয়ে বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন পাশের লালপুর ইউনিয়নের বিধবা মা ও রিকশাচালক ভাইয়ের বাড়িতে।
মামলা সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৩ এপ্রিল উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের কান্দাপাড়ায় মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী ও দুই সন্তানের মা মর্জিনা বেগমের উপর এসিড ছোড়ে দুবৃত্তরা। এতে তাঁর মুখমণ্ডল, মাথা, ঘাড় ও কোমড়সহ সারা শরীর ঝলসে যায়।
ভুক্তভোগী মর্জিনা বেগম জানান, তাঁর স্বামীর সঙ্গে জমি নিয়ে প্রতিবেশী লিটন মিয়াসহ কয়েকজনের বিরোধ ছিল। সেই বিরোধের জেরে ঘটনার দিন গভীররাতে (অনুমান ২টা) লিটন মিয়া, দুলাল মিয়া, জয়নাল মিয়া, বিল্লাল মিয়া ও জাকির মিয়া তাদের বাড়িতে গিয়ে তাঁর স্বামীকে ডাকতে থাকেন। এ সময় মর্জিনার স্বামী মোহাম্মদ আলী গরু পাহাড়া দেওয়ার জন্য গোয়াল ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। ডাক শুনে মর্জিনা দরজা খোলার পর অভিযুক্তরা তাঁর গায়ে এসিড ছুড়ে দৌড়ে পালান। এ সময় তাঁর চিৎকার শুনে স্বামী মোহাম্মদ আলীর ঘুম ভাঙে।
মোহাম্মদ আলী জানান, মর্জিনাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে প্রতিবেশীদের সহায়তায় রাতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। ঢাকায় নেওয়ার পথে আশুগঞ্জ থানা পুলিশকে অবহিত করলে থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাবেদ মাহমুদ ভিকটিমের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। পরের দিন সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শন করে পুলিশ। কয়েকদিন পর ঢাকায় মর্জিনাকে ভর্তি রেখে স্বামী মোহাম্মদ আলী থানায় লিখিত অভিযোগ নিয়ে গেলে ওসি মামলার এজাহার পরিবর্তন করে নিয়ে আসতে বলেন। পরে মোহাম্মদ আলী এজাহার পরিবর্তন না করায় মামলাটি রেকর্ড করেননি তিনি।
মোহাম্মদ আলীর অভিযোগ, স্থানীয় শরীফপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইফ উদ্দিনের কথামতো একজন জনপ্রতিনিধিকে আসামি না করায় চেয়ারম্যানের প্রভাবে মামলাটি রেকর্ড করা হয়নি। পরে তিনি প্রতিবেশী লিটন মিয়া, দুলাল মিয়া, জয়নাল মিয়া, বিল্লাল মিয়া ও জাকির মিয়াসহ অজ্ঞাত আরও দু-তিনজনকে অভিযুক্ত করে জেলা বিজ্ঞ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুল ২-এ মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন।
মোহাম্মদ আলী আরও জানান, মামলার পর তাকে চেয়ারম্যানসহ অভিযুক্তরা ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে তদন্ত কাজে সহযোগিতা করতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন। পাশাপাশি মামলাটি আপসের প্রস্তাব দিচ্ছেন। এসব কারণে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাই নিজের বাড়ি ছেড়ে পাশের ইউনিয়নে শ্বশুরবাড়িতে পরিবারসহ আশ্রয় নিয়েছেন।
এ ব্যাপারে শরীফপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইফ উদ্দিন চৌধুরী তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের বিচার দাবি করেন।
আশুগঞ্জ থানার তৎকালীন ওসি (বর্তমানে সিলেট রেঞ্জে কর্মরত) মো. জাবেদ মাহমুদ জানান, ভিকটিমকে ঢাকায় নেওয়ার পথে তিনি যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন এবং যাদের অভিযুক্ত করেছিলেন এজাহারে তার মিল না থাকায় এজাহার পরিবর্তন করতে বলা হয়। পরে ভিকটিমের স্বামী আর থানায় যোগাযোগ করেননি।
এসিডদগ্ধ মর্জিনার মা জাহানারা বেগম জানান, তিনি ১০ বছর আগে বিধবা হয়েছেন। এক ছেলে রিকশা চালিয়ে সংসার চালান। বর্তমানে মর্জিনা স্বামী ও সন্তানসহ বাবার বাড়িতে আসায় তাদের কষ্ট হচ্ছে।
মামলায় বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহ আলম জানান, মামলাটি আদালত আমলে নিয়েছেন। একজন অতিরিক্ত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শনসহ ভিকটিমের সঙ্গে কথা বলেছেন। দ্রুত এ ব্যাপারে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলেও তিনি আশা করেন।