ঢাকায় আসে কাঁচামাল নিয়ে, চলে যায় যাত্রী নিয়ে
ঘড়ির কাটায় তখন রাত ১২টা। হাজারের কাছাকাছি মানুষ। ছোট বড় সব মিলিয়ে অন্তত ১০০ ট্রাক। বড্ড কোলাহল। সবাই যে যার মতো কাজ করছেন, কারো মুখে আবার করোনাভাইরাসের গল্প। এদের কেউ এসেছেন গ্রাম থেকে, কেউ-বা শহুরে। গ্রাম থেকে আসাদের অধিকাংশই কাঁচামাল ব্যবসায়ী। আর শহুরেরা ঢাকার ছোট ছোট কাঁচাবাজারের খুচরা বিক্রেতা। কেউ আবার স্থানীয় আড়তদারও রয়েছেন।
মানুষে মানুষে ঠাসা। এদের ভেতরে কেউ ট্রাক থেকে কাঁচামাল নামাচ্ছেন, কেউ হাত দিয়ে রাখছেন। কেউ দরদাম করছেন, কেউ বিক্রি করছেন। এই যেমন সাভারের ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম শাক বিক্রি করছিলেন। রাজধানীর শুক্রাবাদের খুচরা বিক্রেতা শাকিল হোসেন সেই শাক কিনছেন। মাহবুব আলম এসে মো. ফুল মিয়ার কাছ থেকে দুই হালি লেবু কিনলেন। সর্বত্র এমন অবস্থা বিরাজমান। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা এমন শতশত পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাকে গতকাল দিবাগত রাত ১২টার সময় দেখা যায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি বাজারে।
কারওয়ান বাজারে কাজ-কর্মে থাকা এসব অধিকাংশ মানুষের মুখে মাস্ক নেই। নেই হ্যান্ডগ্লাভস। কারোই দূরত্ব বজায় রাখার সুযোগ নেই। একটি চায়ের দোকান খোলা থাকায় সবাই সেখানে চা সিগারেট খাচ্ছেন। এই যখন অবস্থা তখন সাভারের মনোগ্রাম ইউনিয়নের শাক ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম পাঁচ টাকা পাইকারি দরে শাকিল হোসেনের কাছে বিক্রি করছিলেন ১০০ তাড়ি। সে সময় সাইফুল বলছিলেন, ‘৩০ পাকি (বিঘা) শাক আছে আমার। অন্তত নয় লাখ টাকা বিক্রি হওয়ার কথা। দুই লাখ টাকা বিক্রি করেছি। আর হয়ত আরো দুই লাখ হবে। পাঁচ লাখ লস যাবে। অর্ধেক দাম সব কিছু। ক্ষেতে আর রাখা যাবে না। এরপর আরো কি অবস্থা হয় তখন আরো মোটেই বিক্রি হবে না। অন্তত পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতি হয়ে যাবে। ক্ষতি হলেও আগামী চার-পাঁচ দিনের ভেতর সব বিক্রি করে দেব। বউ ছেলে-মেয়ে কারওয়ান বাজারে আসতে দিতে চাচ্ছে না ভয়ে। আর এখান থেকে কতজনের করোনা রোগ হবে তার ঠিক নাই। দেখেন না?’
খুচরা বিক্রেতা শাকিল হোসেন বলেন, ‘রাতে আসি প্রতিদিন এখানে। ইদানীং সব কিছুর দাম কম। বিক্রিও কম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানে আসা ঠিক হচ্ছে না। হাজার হাজার মানুষ থাকে এখানে। সবাই যে যার মতো কাজ করছে। কার কীভাবে করোনা হবে আমরা বলতেও পারব না। কয়েক ধরনের তরকারি কিনে চলে যাব ভ্যানে করে।’
মো. ফুল মিয়া একজন লেবু ব্যবসায়ী। সিলেট থেকে লেবু নিয়ে এসেছেন ২০ বস্তা। কুষ্টিয়া আর সিলেটে তাঁর ১৫ বিঘার লেবু বাগান রয়েছে। মাহবুব আলম রায়ের বাজারের খুচরা কাচামাল বিক্রেতা। মাহবুব তাঁর কাছে থেকে দুই পণ (১৬০টি) লেবু কিনেছেন ৭০০ টাকা দিয়ে। বিক্রি করতে করতে ফুল মিয়া বলেন, ‘এত দাম লেবুর। সিজনের সময়ও লস যায় কিন্তু এবার অতিরিক্ত লাভ হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানে নিয়ে আসার। বাড়ির সবাই নিষেধ করছে কিন্তু কিছু করার নেই। কাঁচামাল, ক্ষেতে রাখা যাবে না। তার মানে বিক্রিই করতে হবে। তাছাড়া এখানে আমাদের আসতেই হবে। না হলে শহরের লোকজন খাবে কি?’
মাহবুব আলম বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বেশি চাহিদা লেবুর। অন্য সব ফল বা সবজির দাম কমে গেছে। বিক্রি কম। লেবুতে ভালোই লাভ হচ্ছে। কিন্তু মানুষ বের হতে পারছে না তো।’
নারায়ণগঞ্জ থেকে এক মিনি ট্রাক লাউ লিয়ে এসেছিলেন ফারুক শিকদার। তিনি বলছিলেন, ‘বিক্রি কম। কেউ খাওয়ার জন্য কিনলেও দিচ্ছি। এরপর আর বিক্রি করতে পারব কি পারব না তার ঠিক নেই।’
কারওয়ান বাজারে আরো অন্তত ১৫ জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের। তাদের সবার কণ্ঠে করোনা আতঙ্কে বিদ্যমান। তবু তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসছেন এখানে। এদের ভেতর একজন হাসান আলী। তিনি বলেন, ‘আজই শেষ এখানে আসা। কাল আর আসা যাবে না। সরকার পুরো দেশ লকডাউন করে দিচ্ছে আর এখানে মানুষ গিজগিজ করছে। এখান থেকে যে কত লোকের করোনা হবে তার ঠিক নেই। কারণ, করোনা এখন সারা দেশে ছড়িয়ে গিয়েছে। কার করোনা আছে তা কীভাবে বুঝবেন? আর অধিকাংশই মানুষেরই দেখেন মাস্ক নেই।’
রংপুর থেকে কুমড়া নিয়ে এসেছিলেন মনির হোসেন। তিনিই ট্রাকচালক আবার তিনিই ব্যবসায়ী। রাত ১২টার দিকে মালামাল বিক্রি করে রওনা দেন রংপুরের উদ্দেশে। সে সময় দুজন যাত্রী তাঁকে রংপুর নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। তিনি বললেন, ‘যাওয়া যাবে কিন্তু এক হাজার টাকা দিতে হবে।’
উপায় না পেয়ে এক হাজার টাকা দিয়েই রওনা দেন তাঁরা। জানতে চাইলে মনির হোসেন, ‘ঢাকা থেকে বের হতে পারছে না। তাই নিয়ে যাচ্ছি। আমারো কিছু টাকা হলো।’
মনির হোসেনের কাছে এই প্রতিবেদকও রংপুর যাওয়ার কথা জানান। তখন মনির বলেন, ‘ওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তার ওপারে গিয়ে ট্রাক পাবেন রংপুরে।’
এরপর ওখানে গিয়ে দেখা যায়, অন্তত ৪৫ জন যাত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের অধিকাংশই রংপুর যাবেন। কেউ কেউ অবশ্য বরিশাল কিংবা যশোর যাবেন। সেখানে গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র একজন এসে বলতে শুরু করলেন, ‘যারা যারা রংপুর যাবেন প্রস্তুত হন। ৫০ জন হলেও যাওয়া যাবে। বিশাল বড় ট্রাক। ট্রাক যাত্রাবাড়ী থেকে রওনা দিয়েছে। একটু পরেই এসে যাবে। যে যে যাবেন ৫০০ টাকা করে ভাড়া।’
পরে ওই ব্যক্তির কাছে নাম জানতে চাইলে তিনি তাঁর নাম শাহিন নাম জানান। শাহিন বলেন, ‘বড় ট্রাক, যারা আটকা পড়ে আছেন তাদের যদি আমরা নিয়ে যাই তাহলে ক্ষতি কি? তারাও চলে গেল, আমরাও টাকা পেলাম।’
মেট্রোরেলের এক নিরাপত্তাকর্মী সব সময় সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। নাম না প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এই জায়গা থেকে প্রতিদিন ট্রাকে উঠে মানুষ গ্রামে যাচ্ছেন। পত্রিকার কাগজের গাড়িতেও যাচ্ছে মানুষ। দুই-একটা মাইক্রোবাসেও যাচ্ছে বিভিন্ন জেলায়। তবে ট্রাকেই বেশি যাচ্ছে।’