নবাবদের সম্পত্তি পেতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সলিমুল্লাহর ‘নাতি’র আবেদন
ঢাকার নবাবদের সম্পত্তি নিজের দখলে নিয়ে ভোগ করা ফন্দিফিকির করেছিলেন নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহর ‘নাতি’ হিসেবে পরিচয়দানকারী ‘প্রতারক’ আলী হাসান আসকারী। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করেছিলেন।
জানা গেছে, আজ থেকে প্রায় দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর আলী হাসান আসকারী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয়ে আলাদা দুটি অবেদন করেন। লিখিত দুটি আবেদনপত্রে তিনি বলেন, ‘আমি দরখাস্তকারী (হাসান আসকারী) ঢাকা নবাব এস্টেটের সম্পত্তির মালিক ও ভোগ দখলকার বটে। কিন্তু উক্ত সম্পত্তি আমাকে কোনো প্রকার ভোগ দখল করতে দেওয়া হচ্ছে না।’
ওই দুটি আবেদন ছাড়াও বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয়ে খাজা আমির উল্লাহ ওয়াকফ এস্টেটের বর্তমান মোতাওয়াল্লিকে অপসরণ করে তাঁর পরিবর্তে নিজেকে মোতাওয়াল্লি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্যও একটি আবেদন করেছিলেন ‘প্রতারক’ আলী হাসান আসকারী। এই দরখাস্তটি তিনি করেন ২০২০ সালের ২৬ জুন। তিনটি অবেদনের নথিই এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে করা আবেদনে হাসান আসকারী বলেন, ‘আমি নিম্ন স্বাক্ষরকারী নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী। পিতা মৃত আমান উল্লাহ আসকারী। ঠিকানা ঢাকার লালবাগ থানার ইসলামপুরের নবাববাড়ির আহসান মঞ্জিল। পুরাতন ঢাকায় জন্মলগ্ন থেকে আমাদের পূর্বপুরুষগণ বসবাস করে আসছে। আমি (হাসান আসকারী) ব্যবসায়িক বিভিন্ন কাজ-কর্মে ব্যতিব্যস্ত থাকায়, আমাদের ঢাকা নবাব এস্টেটের ভোগ-দখলীয় সম্পত্তির সঠিকভাবে পরিচালনা ও দেখাশোনা করতে পারিনি। বিধায় কিছু অসাধু ভূমিদস্যুর দল আমাদের ভোগ-দখলীয় সম্পত্তি জোরপূর্বক দখল করে তাতে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ করে ভোগ-দখল করে আসছে।’
আবেদনপত্রে হাসান আসকারী বলেন, ‘উক্ত সম্পত্তি আমি ভোগ-দখল করতে চাইলে বিংবা আমার ঢাকা নবাব এস্টেটের সম্পত্তি বুঝে নিতে চাইলে কিছু অসাধু ভূমিদস্যু ও দালালচক্রের ব্যক্তিগণ আমাকে ওই সম্পত্তি ভোগদখল করতে দিচ্ছে না। উল্টো আমাকে অবৈধভাবে হুমকি প্রদান করছে যে, যদি উক্ত সম্পত্তির কাছে আমি যাই তাহলে আমাকে মেরে লাশ গুম করে দেবে। এবং আমার পরিবারের ক্ষতি করবে।’
আসকারী বলেন, ‘আমি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি যে, উক্ত অবৈধ ভূমিদস্যুর লোকজন আমাদের নবাব এস্টেটের সম্পত্তি আত্মসাৎ করে ভূয়া ও জাল-জালিয়াতিপূর্ণ কাগজপত্র সৃষ্টি করেছে। ওই অবৈধ কাগজপত্র দিয়ে কুচক্রিমহল এলাকায় বলে বেড়াচ্ছে যে, উক্ত সম্পত্তি আমাদের (দখলকারী)। এতে কোনোপ্রকার নবাব এস্টেটের সম্পত্তি নেই।’
ওই আবেদনপত্রে নবাব এস্টেটের ওয়ারিশদের পর্যায়ক্রমিক একটি তালিকা দেন আলী হাসান আসকারী। সেখানে তিনি বলেন, ‘মৃত নবাব আলীম উল্লাহর এক পুত্র, মৃত খান বাহাদুর নবাব আবদুল গনির এক পুত্র, মৃত খান বাহাদুর নবাব আহসান উল্লাহর এক পুত্র, মৃত খান বাহাদুর নবাব স্যার সলিমুল্লাহর এক পুত্র, মৃত খান বাহাদুর নবাব হাবিব উল্লাহর এক পুত্র, মৃত নবাব মেজর হাসান আসকারীর এক পুত্র, মৃত নবাব আমান উল্লাহ আসকারীর এক পুত্র এবং নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী (আমি নিজে)।’
আবেদনপত্রের শেষে আসকারী লেখেন, ‘এতএব জনাবের নিকট বিনীতভাবে আবেদন এই যে, উপরোক্ত বিষয়টি পর্যালোচনা করে কাগজপত্র যাচাই-বাচাই করে ঢাকা নবাব এস্টেটের সম্পত্তি সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেওয়া ও আমার নামে নামজারিসহ যাবতীয় কার্যক্রম করতে পারি তার বিহিত ব্যবস্থা করিতে আপনার মর্জি হয়।’ ভূমি মন্ত্রণালয়েও তিনি এই একই আবেদন জমা দেন।
প্রায় সোয়া তিন কোটি টাকা প্রতারণা করার অভিযোগে আলী হাসান আসকারী এখন কারাগারে। কারাগারে পাঠানোর আগে গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডের ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কার্যালয়ে আলী হাসান আসকারীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সে সময় তাঁর কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, ‘আপনি কি নবাবদের সম্পত্তি ফিরে পেতে আবেদন বা মামলা করেছেন?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আবেদন করেছি। আগামীতে মামলাও করব।’
আলী হাসান আসকারীর মামলাটি তদারকি করছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের সিটিটিসির উপকমিশনার (ডিসি) মো. মাহফুজুল ইসলাম। নবাব পরিবারের জমি ফিরে পেতে আসকারীর আবেদনের ব্যাপারে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরাও শুনেছি। আমরা বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত করে দেখছি। হাসান আসকারী একজন বড় প্রতারক। মূলত ২০১৪ সালের পর থেকে তিনি নবাব পরিবারের সদস্য হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে শুরু করেন। তারপর থেকে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র ও সনদপত্র সংশোধন করে এসব করা শুরু করেছেন। রিমান্ডে নিয়ে আমরা তার কাছে এসব ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম। আসকারী স্বীকার করেছেন তিনি নবাব পরিবারের কেউ না। আমাদের তার প্রকৃত নাম বলেছে কামরুল হাসান হৃদয়। কিন্তু ওই নামও যে ভূয়া না তা আমরা এখনি বলছি না। দেখা যাবে, নতুন নাম বলাও তার প্রতারণার একটি অংশ। আমরা এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি।’