নবীগঞ্জে ড্রাগন চাষে আগ্রহ বাড়ছে
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার মাটি ও আবহাওয়া চাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় সম্প্রতি বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে বহুগুণ সমৃদ্ধ বিদেশি ড্রাগন ফল চাষ। এরই মধ্যে ড্রাগন চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন মশিউর রহমান নামের এক চাষি।
আর এতে এলাকায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে। বাজারে ফলের ভালো দাম ও চাহিদা থাকায় দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ড্রাগন ফলের চাষ। আর অল্প সময়েই অল্প পুঁজিতে ড্রাগন ফল চাষ করে বেকার যুবকদের সাবলম্বী হওয়ার বিশাল সুযোগ রয়েছে বলে মনে করে কৃষি অধিদপ্তর।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নবীগঞ্জ উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চল হিসেবে খ্যাত দিনারপুরের পানিউমদা গ্রামের ভিতরে অনেক উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে ববানি চা বাগানের অবস্থান। আর পাহাড়ের পাদদেশে এই চা বাগানে একাংশেই প্রায় এক একর জমিতে বিদেশি ফল ড্রাগন চাষ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বাগানের মালিক মশিউর রহমান। এখন এলাকার অনেকেই এ ফল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
ড্রাগন ফল সম্পর্কে আমাদের দেশের মানুষ আগে তেমন পরিচিত ছিল না। বেশ কয়েক বছর আগেও বিদেশ থেকে ড্রাগন ফল আমদানি করা হতো। দেশের বড়ো বড়ো সুপারশপগুলোতে উচ্চদামে ড্রাগন ফল বিক্রি হতো। দেশের বেশ কিছু উৎসাহী ব্যক্তি থাইল্যান্ড থেকে ড্রাগন ফলের চারা এনে পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করে। এতে তারা সফল হয়। ২০১০ সালের দিকে এ দেশে সর্বপ্রথম ড্রাগন ফলের চাষ শুরু হয়। ২০১৫ সাল থেকে বাণিজ্যিকভিত্তিতে ড্রাগন ফলের চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ফলের চাষ হচ্ছে।
নবীগঞ্জের ববানি ড্রাগন বাগানের ম্যানেজার বিনয় চন্দ্র বর্মণ জানান, বাগানের মালিক মশিউর রহমানের উদ্যোগে প্রায় এক বছর আগে চা বাগানের এক একর জমিতে শুরু করেন ড্রাগন চাষের কর্মপরিকল্পনা। প্রথমে সিমেন্ট দিয়ে প্রায় ৫০০টি পিলার তৈরি করেন। পরে গর্ত করে ওই স্থানে পিলারগুলোকে দাঁড় করিয়ে একটি পিলারের চারপাশে চারটি করে ড্রাগনের চারা রোপণ করেন। এভাবে প্রায় দুই হাজার চারা রোপণ করেন। এতে পরিচর্যাসহ সব মিলিয়ে ব্যয় হয় প্রায় সাত লাখ টাকা। প্রথম মৌসুমেই দেড় লক্ষাধিক টাকার ফল বিক্রি করেছেন। এখন পরিচর্যা ছাড়া কোনো ব্যয় নেই, শুধু আয়ের পালা। কোনো ব্যয় ছাড়া সামনে আরো তিনগুণ বেশি ফল বিক্রি করে টাকা আয়ের আশা করছে বাগান কর্তৃপক্ষ।
ওই এলাকার বাসিন্দা নবীগঞ্জ উপজেলা মতিউর রহমান মুন্না বলেন, আমাদের ঐতিহ্যবাহী দিনারপুর অঞ্চল এক সময় পশুপাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকত। কিন্তু কালের বিবর্তনে আজ এই সৌন্দর্য হারিয়ে যেতে বসেছে। কিছু দিন পর পরই পাহাড় নিধনে পাহাড়খেকোরা সক্রিয় হন ফলে পরিবেশের ক্ষতি হয়। পাহাড় কেটে জঙ্গল খালি হয়ে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো পশুপাখি দেখা যায় না। তবে চা বাগান, রাবার বাগান, ড্রাগন বাগানসহ কিছু বাণিজ্যিকভাবে স্থাপনা গড়ে উঠায় এখন প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকরা আসেন। ড্রাগন চাষেও কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। পাহাড়ি অঞ্চলের ঐতিহ্য রক্ষায় তিনি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
নবীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ কে এম মাকসুদুল আলম বলেন, রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম বিধায় ড্রাগন ফল চাষে কৃষক লাভবান হচ্ছে। নবীগঞ্জ উপজেলায় বেশ কয়েকটি ড্রাগনের বাগান তৈরি হয়েছে। এই ড্রাগন বাগানগুলো দেখে কৃষকরা ফলটি চাষ করতে আগ্রহী হচ্ছে, প্রায়ই চারার জন্য যোগাযোগ করছে। এই চারা রোপণ করলে সহজে মারা যায় না। কেউ বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগন চাষ করতে চাইলে উপজেলা কৃষি অফিসের পরার্মশ নিতে বলেন তিনি।
সম্প্রতি ববানি বাগান পরির্দশনে আসেন কৃষি অধিদপ্তর, সিলেট কৃষি তথ্য সার্ভিস ও নবীগঞ্জ কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা।
এ সময় হবিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক তমিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘আমাদের দেশে ড্রাগন ফল সম্ভাবনাময় একটি ফল। ফলের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। ফলটিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি আছে। ক্যান্সারসহ অনেক জটিল রোগের প্রতিরোধক হিসেবে ড্রাগন ফলটি কাজ করে। ফলটি স্বাস্থ্যের জন্য খুবই প্রয়োজন।’ তিনি আরো বলেন, ‘গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে দারুণ ভূমিকা রাখবে ড্রাগন এবং অনেক কম শ্রমে বিদেশি ফলটি চাষ করা যায়। অন্য ফসলের তুলনায় এই ফল চাষে ব্যয় কম, আয় বেশি।’
সংশ্লিষ্টদের মতে, শিক্ষিত বেকাররা চাকরির পেছনে না ছুটে বসতবাড়ির আশপাশে ড্রাগন ফল চাষ করে নিজেদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারে। অন্যদিকে ব্যক্তিগত আয়ের পথ সুগম হবে।
সূত্র বলছে, ডায়াবেটিস ও খারাপ কোলেস্টেরল কমায় ড্রাগন ফল। এতে প্রচুর আঁশ থাকায় হজম শক্তি বাড়াতে ও চর্বি কমাতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত ক্যারোটিন থাকায় স্মৃতি শক্তি ও চোখের জ্যোতি বাড়ায়। ভিটামিন বি-২ থাকায় ক্ষুধা বাড়ায় ও স্বাভাবিক কর্মপন্থা উন্নত করে এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমায়। এ ফলে ‘বি’ সিটোস্টরেল থাকায় হাইপার টেনশন কমায়। ত্বকের মসৃণতা ও আর্দ্রতা ধরে রাখে। ভিটামিন বি-৩ থাকায় শরীরের রক্ত প্রবাহ বাড়ায়, খারাপ কোলেস্টেরল ও রক্ত চাপ কমায়। রক্তের শিরা প্রশন্ত করে ও মাইগ্রেনের ব্যথা কমায়।
এটি ভিয়েতনামের জাতীয় ফল ড্রাগন হলেও সম্প্রতি সময়ে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে এই ফলের আবাদ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া ড্রাগনের সাদা শাঁসের রস প্রসাধনী গুণের আধার।