নিহত ঢাবির ছাত্র লিমনের বাড়িতে শোকের মাতম
‘বাবারে আমরা গরিব মানুষ, কষ্ট করে লেখাপড়া শিখাইছি বাচ্চাদের মানুষ করার জন্য। যে বাচ্চারা ভবিষ্যতে মানুষ হবে। ওরা করি মলি খাবে। আমাদের কপালে যা হয় হইবে। সব আশা আজকে আমার ধূলিসাৎ হয়ে গেল। বাবার আশা ছিল বড় হব, যখন ভার্সিটির লেখাপড়া শেষ হবে, আমি চাকরি পাব, সেরকম যদি হয় আমি ভার্সিটির প্রভাষক হব। আশা স্বপ্ন সব শ্যাষ হয়া গেল। সরকার যদি এই অভাবের সংসারে সহযোগিতা করে, তবুও ছেলে তো চিরদিনের জন্য চলে গেল। ছেলে তো আর ফিরে আসবে না।’
চোখে পানি নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জগন্নাথ হলের সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ভবনের ওপর থেকে পড়ে নিহত শিক্ষার্থী লিমন কুমার রায়ের মা লীলা রাণী রায়।
আজ বুধবার সকালে ঢাবির জগন্নাথ হলের ১০তলার ছাদ থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন লিমন। সকাল সাড়ে ১০টায় গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
লিমন নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের মাগুড়া দোলাপাড়া এলাকার প্রতাপ চন্দ্র রায়ের ছেলে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। থাকতেন জগন্নাথ হলের সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ভবনের একটি কক্ষে।
লিমন ২০১৭ সালে মাগুড়া শিঙ্গেরগাড়ি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১৯ সালে রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। দুই পরীক্ষাতে জিপিএ ৫ পেয়েছিলেন তিনি। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন তিনি।
লিমন সব সময় মানুষের মঙ্গলের কথা চিন্তা করতেন। করোনাকালে লকডাউনের সময় গ্রামের বাড়িতে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি একটি পাঠশালা গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে পড়াতেন।
লিমনের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার মা-বাবা আহাজারি করছেন। আত্মীয়স্বজনও শোকে মূহ্যমান। তার মৃত্যুর খবরে তার বাড়িতে এসে ভিড় করছেন পাড়া-প্রতিবেশীরা।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে লিমনের বাবা প্রতাপ চন্দ্র রায় বলেন, ‘কী আর বলব, ছেলেকে তো কষ্ট করে লেখাপড়া শিখাইতেছি, পরিশ্রম করতেছি। সরকারের কাছে দাবি, আর তো একটা ছেলে একটা মেয়ে আছে, ওদের যেন কিছু সহযোগিতা করে। এটাই আমার সরকারের কাছে আশা।’
লিমনের ছোট ভাই সুমন চন্দ্র রায় বলেন, সকালে স্কুলে যাওয়ার পর দাদার বন্ধু আমাকে ফোন দিয়ে খবর জানায় যে, দাদা অসুস্থ হাসপাতালে ভর্তি। এটা শোনার পর আর থাকতে পারলাম না স্কুলে। বাড়িতে এসে কিছুক্ষণের মধ্যে শুনি যে দাদা মারা গেছেন। আমার দাদার স্বপ্ন ছিল আমি বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হই। ছোট বোনটাকে সে ডাক্তার তৈরি করবে। তা তো আর হলো না। এখন আমরা কীভাবে চলব। সরকারের কাছে একটা মিনতি, আমাদের দিকে একটু দেখেন—তাহলে আমাদের দাদার স্বপ্ন আমরা পূরণ করতে পারব।
প্রতিবেশি নারায়ণ চন্দ্র রায় বলেন, লিমন খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাকে নিয়ে গ্রাম ও তার পরিবারের সবার একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। তিনি মানুষের মতো মানুষ হলে আগামীদিনের গ্রামের সবার মুখ উজ্জ্বল হতো। তার বাবা রিকশা চালিয়ে তার লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। তিনি ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। সবার আশা ছিল লেখাপড়া শেষ হলে তার ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়ায় সমস্যা হবে না।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আকতারুজ্জামান মিঠু বলেন, লিমনের বাবা খুবই অসহায়, গরিব। রিকশা চালিয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালান। লিমনের প্রতি তাঁর মা-বাবার অনেক আশা ছিল। সে লেখাপড়া শেষ করে সংসারের হাল ধরবে। তার মধ্যেই এ দুর্ঘটনা ঘটে গেল। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় খবরটা শুনে এখানে ছুটে এসেছি। চেষ্টা করছি অক্ষত অবস্থায় তার মরদেহটা গ্রামে নিয়ে আসার। তার পরিবারের পাশে আমি সবসময় আছি। পাশাপাশি সরকার এই অসহায় পরিবারটিকে একটু যদি দেখে।