নীলফামারীতে ওএমএসের চাল-আটার জন্য দীর্ঘ সারি

‘দোকান থাকি কিনিবার গেইলে সবচেয়ে কমদামের চাউলের দাম ৪০ টাকা, তার উপরোত ৬০-৭০ টাকাও আছে। অত দামের চাউল কিনি খাওয়া খুব কষ্ট হয়ছে হামার। এই জন্যে ওএমএসের এইঠে আসুনু। এইঠে ৩০ টাকা দরে চাউল পাওয়া যায়। খুব ভিড় ছিল, তাও পাঁচ কেজি চাল পানু।’
আজ শনিবার দুপুরে বলছিলেন জেলা শহরের গাছবাড়ি পয়েন্টে ওএমএসের চাল-আটা নিতে আসা সদর উপজেলার খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের হালিরবাজার এলাকার ৫৫ বছর বয়সী বিধবা ফিরোজা বেগম।
বিধবা ফিরোজার মতো চাল নিতে এসেছেন শহরের বারইপাড়া এলাকার তাসলিমা বেগম, শান্তি বালাসহ তিনশতাধিক মানুষ।
এই পয়েন্টে ২০০ জনের মধ্যে এক মেট্রিন টন চাল ও এক মেট্রিক টন আটা বিক্রি করা হয় এদিন। তবে চাল ও আটা না পেয়ে ফেরত যেতে হয়েছে শতাধিক মানুষকে।
চাল না পেয়ে এক রিকশাচালক অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি শহরে থাকি, অনেক মানুষ আসে। শুধু শহরের নয় গ্রাম থেকেও এখানে চাল-আটা নিতে আসছে মানুষ। বিশেষ করে গেল এক মাস ধরে নতুন নতুন মুখ আসছে ওএমএসের খাদ্যদ্রব্য নিতে। তারা সবাই ইউনিয়ন পর্যায়ের মানুষ। গ্রাম পর্যায়েও খোলা বাজারে চাল-আটা বিক্রি করা দরকার।’
রিকশাচালক আরও বলেন, ওএমএসে চাল ৩০ টাকা এবং আটা ১৮ টাকা কেজি দরে কেনা যায়। কিন্তু দোকানে চাল ন্যূনতম ৪০ টাকা কেজি এবং আটা ৩০-৩৫ টাকা কেজিতে কিনতে হয়।
খাদ্য অধিদপ্তরের ডিলার হরিপদ মজুমদার বলেন, মানুষ অনেক সকালে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা ২০০ জনকে দিতে পারি কিন্তু মানুষ আসে ৩০০ এরও বেশি। আমরা যতটুকু বরাদ্দ পাই ততটুকু লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের দিয়ে দেই।
হরিপদ মজুমদার আরও বলেন, এক মাস থেকে অনেক মানুষ আসছে, যারা আগে কখনও আসেনি।
সৈয়দপুর শহরের রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় এসেছেন চল্লিশোর্ধ শাহজাহান আলী (৪০)। কাপড়ের ফেরি করেন। বাজারে চাল ও আটাসহ নিত্যপণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখীতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছেন দীর্ঘ লাইনে। এর আগে কোনোদিন লাইনে দাঁড়াতে হয়নি তাঁকে।
শাহজাহানের মতো সাশ্রয়ী দামে পণ্য দুটি কিনতে ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) কেন্দ্রে এভাবে ছুটছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা।

সৈয়দপুরের গির্জা মোড়, দারুল উলুম মোড়, ক্যান্টনমেন্ট বাজার ও বার্মসেল স্টেশনের সামনে ওএমএস ডিলার কেন্দ্রের সামনে দেখা গেছে এমন চিত্র। নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত, নারী, পুরুষ এমনকি শিশুরাও দাঁড়াচ্ছে লাইনে।
বার্মাসেল স্টেশন এলাকায় ওএমএসের চালের জন্য লাইনে দাঁড়ানো রোকসানা বেওয়া বলেন, ‘চালের জন্য সকাল ৯টায় লাইনে দাঁড়িয়েছি। ১০টার দিকে চাল বিক্রি শুরু হয়। পাঁচ কেজি চাল ও আটার জন্য এক-দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়। এরপরও কিনতে পারলে খুশি।’
ক্যান্টনমেন্ট বাজার ওএমএস ডিলার কেন্দ্র এলাকায় শামসুদ্দিন আহমেদ (৫৬) বলেন, কোনো দিন ওএমএসের চালের জন্য লাইনে দাঁড়াইনি। এখানে বাজার থেকে ১০০ টাকা কমে পাচ্ছি। বর্তমানে জিনিসপত্রের যে দাম তাই বাধ্য হয়ে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকেও আফসোস নেই এখন আমার।
বার্মাসেল এলাকার ডিলার গুলজার হোসেন জানান, চাল-আটা নিতে আসা ক্রেতার চাপ বেশি থাকায় চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছি। ক্রেতাদের চাপ অনেক বেশি। বিক্রির জন্য যে চাল ও আটা বরাদ্দ পেয়েছি, তা উপস্থিত মানুষদের তুলনায় খুব কম।
স্থানীয়রা বলছে, বর্তমানে বাজারে সব জিনিসের দাম ঊর্ধ্বমুখী। তা ছাড়া বাজারে চাল ও আটার চাহিদা অনেক বেশি। এ কারণে নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তরা ওএমএসের চাল কিনতে ছুটে আসছে। অনেকে সকাল সকাল লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে।
খাদ্য বিভাগ জানায়, জেলার চার পৌরসভা এলাকায় ২৫ জন ডিলারের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে চাল ও আটা বিক্রি করা হচ্ছে। এর মধ্যে নীলফামারী পৌরসভা এলাকায় ১৫ জন, জলঢাকায় তিনজন, ডোমারে তিনজন এবং সৈয়দপুরে চারজন রয়েছেন।
ডিলাররা শুক্রবার বাদে বাকি ছয়দিন রোটেশন অনুযায়ী দুই টন করে আটা ও চাল বিক্রি করে থাকেন।
সৈয়দপুর উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা নুর ইসলাম বলেন, এখন চাহিদা বেড়েছে। ক্রেতাদের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ডিলার সংখ্যাও বৃদ্ধি এবং বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীম হুসাইন বলেন, সরকার খেটে খাওয়া মানুষদের পাশে থাকতে বদ্ধপরিকর। নিম্ন আয়ের মানুষদের কথা বিবেচনা করে বরাদ্দ ও ডিলার সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টি আমরা গুরুত্বসহকারে দেখছি। যাতে সব ক্রেতা চাল-আটা কিনতে পারে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামে গ্রামে ওএমএস চালু করার দাবি জানিয়েছেন কৃষক ও ক্ষেতমজুর নেতারা।
জাতীয় কৃষক সমিতি ও ক্ষেতমজুর ইউনিয়নের সভাপতি তপন কুমার রায় বলেন, শুধু শহর এলাকায় ওএমএসের মাধ্যমে সরকার স্বল্পমূল্যে চাল-আটা বিক্রি করছে। এই সুবিধা ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বাড়ানো দরকার। কারণ গ্রামের মানুষরাও বিপাকে পড়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ করব, ইউনিয়ন পর্যায়ে অন্তত তিনজন ডিলারের মাধ্যমে চাল-আটা বিক্রি করার উদ্যোগ নেওয়া হোক।
জানতে চাইলে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নাজমুল হক ভুইয়া ওএমএস পয়েন্টগুলোতে ভিড় বেড়েছে জানিয়ে বলেন, এজন্য যথাযথভাবে তদারক করা হচ্ছে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী যাতে চাল-আটা বিক্রি করা হয়, সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ডিলারদের। মাঠ পর্যায়ে ডিলার পয়েন্টে দপ্তরটির কর্মীরাও কাজ করছেন। সম্প্রতি অনিয়ম করায় দুজন ডিলারকে জরিমানা করা হয়।