বিএনপি অংশ না নিলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না : সাবেক সিইসি
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করলে ওই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না, এমন প্রশ্নে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার উত্তর, ‘না, পাবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, এই নির্বাচনে বিএনপিকে নির্বাচনী মাঠে আনতে হবে এবং সেটার দায়িত্ব সরকারি দলকে নিতে হবে।’ একই সঙ্গে বিএনপিকে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান তিনি। এর আগে সিইসি থাকা অবস্থায় নূরুল হুদা একই কথা বলেছিলেন।
২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হয় কে এম নূরুল হুদা কমিশনের। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আজ শনিবার প্রথম গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন তিনি। দুপুরে তেজগাঁওয়ের এফডিসিতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন সম্ভব’ শীর্ষক ছায়া সংসদে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে সিইসি এসব মন্তব্য করেন।
কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘বিএনপিকেও আমার অনুরোধ থাকবে, নির্বাচন বর্জন করে, বয়কট করে সমস্যার সমাধান হবে না। আপনারা আলোচনা করে ঠিক করবেন কীভাবে নির্বাচনে যাবেন।’
বিএনপি না এলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না বলে নিজের মেয়াদকালে কে এম নূরুল হুদা ২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ দল। তারা নির্বাচনে না এলে সব দলের নির্বাচন হবে না। তাদের ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না।’
জাতীয় সংসদের লক্ষ্মীপুর-২ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০২১ সালের ২১ জুন। বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এ আসন থেকে দুবার নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। সে হিসেবে আসনটি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু, এই নির্বাচনে বিএনপির কোনো প্রার্থী ছিল না। ওই সময় অর্থাৎ, ১৬ জুন নির্বাচনী পরিবেশ দেখতে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে যান কে এম নূরুল হুদা। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে ভালো হতো।’
একইসঙ্গে নূরুল হুদা বলেন, ‘কেন করেনি তা তো আমি বলতে পারব না। নির্বাচন কমিশনের কাজ হলো ম্যানেজমেন্ট করা। এখানে প্রার্থী কারা দেবে, কোন কোন রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করবে, এটা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এতে আমরা কিছু করতে পারি না।’
আজ শনিবার গণমাধ্যমে কথা বলার সময় কে এম নূরুল হুদার কাছে ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি নিজের অস্বস্তির কথা জানিয়ে বলেন, ‘কতগুলো বিষয় নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলাম। কোথাও কোথাও শতভাগ ভোট পড়েছে। এগুলো আমি সাংবাদিকদের বার বার বলেছি। মেয়াদ শেষের আগেই আমি এসব প্রশ্নের উত্তর মিডিয়ার সামনে পরিষ্কার করেছি। এটা একটা অস্বস্তিকর বিষয়। এটা গ্রহণযোগ্য বিষয় নয় যে, শতভাগ ভোট হবে। শতভাগ ভোট পড়াটা অস্বাভাবিক।’
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছয় মাস পর নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রভিত্তিক যে ফলাফল প্রকাশ করে তাতে ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়তে দেখা যায়।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মোট ভোটকেন্দ্র ছিল ৪০ হাজার ১৫৫টি। এর অর্ধেকের বেশি, ২৩ হাজার ৬২১ কেন্দ্রে পড়েছে ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ ভোট। আর ৭০ শতাংশের ওপরে ভোট পড়ে ৩৩ হাজার ৬৯৪টি কেন্দ্রে।
অস্বস্তির বিষয় তুলে ধরার পাশাপাশি আজ কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘তবে আমি সঙ্গে সঙ্গে বলেছি যে, এখান থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হলো আদালত। ইসির সীমাবদ্ধতা হলো রিটার্নিং অফিসার যদি আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা করেন, তাহলে ইসির হাতে আর কিছু করার থাকে না। সেটা চলে যায় আদালতে।’ তফসিল ঘোষণার পর থেকে ফলাফল প্রদান পর্যন্ত ইসির নির্বাচন সংক্রান্ত কাজ’ যোগ করেন সাবেক সিইসি।
এক প্রশ্নের জবাবে নূরুল হুদা বলেন, ‘দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনা করা ইসির জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জ। তবে, সেটি কমিশন চাইলে অতিক্রম করা সম্ভব। পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনকালে কোনো চাপ সৃষ্টি হয়নি।’
সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে না পারলে পদত্যাগের বিষয়ে নূরুল হুদা বলেন, ‘পদত্যাগ করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। পদত্যাগ কাপুরুষোচিত বিষয়। এটি আমার পছন্দ নয়।’
সাবেক এই সিইসি নূরুল হুদা বলেন, ‘বন্দুকের নল ও লাঠিচার্জ করে গণতন্ত্র কায়েম করা যায় না, উচিতও না। আমাদের দেশে যেটা হয়, এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জনগণ ভোট দিতে যাবেন স্বেচ্ছায়।’
নূরুল হুদা আরও বলেন, ‘অন্যকোনো দেশে আমাদের মতো নির্বাচনের সময় যুদ্ধ করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় না। জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে যাবে, সেখানে কেনো পুলিশ থাকবে, আর্মি থাকবে, বিজিবি থাকবে, র্যাব থাকবে, ম্যাজিস্ট্রেট থাকবে? ১১-১২টা সংস্থা নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালন করে। কেন? এখানে থাকবে শুধু নির্বাচন ব্যবস্থাপনার লোক ও ভোটার। এই অবস্থার অবসান তাৎক্ষণিকভাবে হবে না। এর জন্য সময় লাগবে, ধৈর্য লাগবে এবং কালচার লাগবে।’
গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ ১০ দফা সুপারিশ তুলে ধরেন। সেগুলো হলো-
১. আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ তাদের শরিকদের মধ্যে আালোচনার মাধ্যমে নির্বাচনের রূপরেখা ও রোডম্যাপ তৈরি করা।
২. নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন নির্মোহ পেশাজীবী ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিদের সঙ্গে সংলাপে যেসব প্রস্তাব এসেছে সেগুলো প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা।
৩. বিগত নির্বাচন কমিশনগুলোর চ্যালেঞ্জের বিভিন্ন দিক চিহ্নত করে বর্তমান কমিশনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৪. সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ না থাকলে বর্তমান কমিশনকে পদত্যাগ করার মানসিকতা রাখা।
৫. রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে ইভিএমের ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
৬. নির্বাচনের পূর্বে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ দূর করতে ইসিকে সরকারের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
৭. অকারণে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার মতো পরিবেশ যেন তৈরি না হয়, সেদিকে ইসিকে দৃষ্টি দেওয়া।
৮. যেসব আইনের দ্বারা নির্বাচনকালীন সংবাদ পরিবেশনে গণমাধ্যম বাধার সম্মুখীন হতে পারে, সে আইন বাতিল করা।
৯. নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী মতের রাজনৈতিক দলগুলোতে উন্নয়ন ব্যাহত হয়, এমন কর্মসূচি পরিহার করা।
১০. জেলা প্রশাসকদের বদলে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া।
প্রতিযোগিতায় কুমিল্লা ইউনিভার্সিটিকে পরাজিত করে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বিতার্কিকরা বিজয়ী হন। ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র আয়োজনে ছায়া সংসদের বিষয় ছিল—‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন সম্ভব।’
ছায়া সংসদে মক স্পিকার হিসেবে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মোহাম্মদ রইস, ড. এস এম মোর্শেদ, সাংবাদিক তানিয়া রহমান ও একরামুল হক সায়েম। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী দলের মাঝে ট্রফি ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।