বিএনপি নেতা মিনুসহ চারজনের নামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আবেদন
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনুসহ চার নেতার বিরুদ্ধে রাজশাহীতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আবেদন করা হয়েছে। গত ২ মার্চ বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ইঙ্গিতপূর্ণ হুমকি ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ এনে মামলার এই আবেদন করেন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোসাব্বিরুল ইসলাম।
আজ মঙ্গলবার সকালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে করা এই আবেদনে মিজানুর রহমান মিনু ছাড়াও আসামি করা হয়েছে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, রাজশাহী মহানগর বিএনপির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ও সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিলনকে।
আজ দুপুরে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে মামলার বিস্তারিত তথ্য জানান মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত মামলার আবেদনকারী অ্যাডভোকেট মোসাব্বিরুল ইসলাম জানান, মিনুসহ চারজনের বিরুদ্ধে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ দিয়ে তা আমলে নেওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছেন তিনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আবেদনটি অনুমোদিত হলে তা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হিসেবে রেকর্ড হবে।
মামলার আবেদনে বলা হয়েছে, গত ২ মার্চ বিএনপি রাজশাহীতে বিভাগীয় সমাবেশ করে। মহানগর বিএনপির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলনের সঞ্চালনায় সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার উৎখাতের অসৎ উদ্দেশ্যে নেতাকর্মী, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে মিজানুর রহমান মিনু প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘হাসিনা রেডি হও, আজ সন্ধ্যার সময়, কালকে সকাল তোমার নাও হতে পারে, মনে নাই পঁচাত্তর সাল? পঁচাত্তর সাল মনে নাই?’
মামলার আবেদনে আরও বলা হয়, মিনুর এই ঘোষণার পর বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে উগ্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। কিছু নেতাকর্মী সমাবেশের এ বক্তব্য ফেসবুকে লাইভ সম্প্রচার করে। সমাবেশে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা রুহুল কুদুস তালুকদার দুলুসহ অন্যরাও একইভাবে বক্তব্য দিয়ে ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করেন এবং বেআইনিভাবে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকার উৎখাতের হুমকি দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাসহ নির্বাচিত সরকার উৎখাতের প্রকাশ্য ঘোষণা ও হুমকি দিয়ে তাঁরা রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ করেছেন। যা বাংলাদেশের নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি বিপদজনক ও হুমকিস্বরূপ।
এদিকে, সংবাদ সম্মেলনে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘আবেদনটি হাতে পাওয়ার পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগের তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পুলিশ কমিশনারের কাছে পাঠিয়েছেন। পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাবে। সেখান থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর মামলাটি রেকর্ড হবে। এ প্রক্রিয়া শেষ করতে দুই তিন দিন সময় লাগবে।’
মেয়র লিটন বলেন, ‘গত ৩ মার্চ মহানগর আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সভায় মিজানুর রহমান মিনুসহ বিএনপি নেতাদের ক্ষমা চাইতে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছিল। গত ৬ মার্চ আল্টিমেটামের সময় শেষ হয়। গত রোববার মিজানুর রহমান মিনু ক্ষমা না চেয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। ফলে ক্ষমা না চাওয়ায় মহানগর আওয়ামী লীগ মিনুসহ বিএনপির চার নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়।’
সংবাদ সম্মেলনে আর উপস্থিত ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবাল, নওশের আলী, সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার, সংগঠনিক সম্পাদক মীর ইসতিয়াক আহমেদ লেমন প্রমুখ।
মিজানুর রহমান মিনুর দুঃখ প্রকাশ
এদিকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবজ্ঞা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘হত্যার’ ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দেওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু। গত রোববার রাজশাহী মহানগর বিএনপির ই-মেইল থেকে গণমাধ্যমের কাছে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এই দুঃখ প্রকাশ করেন।
এর আগে মিনুকে ক্ষমা চাইতে মহানগর আওয়ামী লীগের বেঁধে দেওয়া ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম শেষ হয় গত শনিবার সন্ধ্যায়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ক্ষমা না চাইলেও পরদিন তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। যোগাযোগ করা হলে মিজানুর রহমান মিনু এই বিবৃতিটি পাঠানোর বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
এদিকে, মিনু বিবৃতি পাঠানোর আগে আল্টিমেটামের সময় শেষ হওয়ায় মহানগর আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। গত রোববার ৭ মার্চের আলোচনা অনুষ্ঠানেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনায় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন উপস্থিত ছিলেন। সেই আলোচনা সভায় মিনুর বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়।
এদিকে, গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে মিজানুর রহমান মিনু উল্লেখ করেন, ‘আমার বক্তব্যের জন্য যাঁরা ব্যথিত হয়েছেন, মর্মাহত হয়েছেন, আমি তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি।’
মিনু আরও বলেন, ‘আমি এই মহানগরীতে জন্মগ্রহণ করে দীর্ঘদিন রাজশাহীবাসীকে নিয়ে রাজনৈতিক নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছি। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ সব আন্দোলনে পাশে পেয়েছি। সুতরাং কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠী বিশেষকে উদ্দেশ্য করে আক্রোশমূলক বক্তব্য দেওয়া আমার স্বভাববহির্ভুত। তাই সবাইকে আমার বক্ত্যব্যে ষড়যন্ত্র না খোঁজার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
এর আগে গত মঙ্গলবার বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সমাবেশে মিজানুর রহমান মিনু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আজ রাত, কাল আর সকাল নাও হতে পারে। পঁচাত্তর মনে নাই?’ সেই সমাবেশে মিনু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও কটাক্ষ করে বক্তব্য দেন মিনু। এর প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে মহানগর আওয়ামী লীগ। পরদিনই বিক্ষোভ-সমাবেশ করে দলটি। সেই সমাবেশ থেকে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন মিনুকে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। লিটন ঘোষণা দেন, এই সময়ের মধ্যে মিনু ক্ষমা না চাইলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা কথা বলেছিলেন।
এছাড়া বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা এক প্রতিবাদলিপিতে মিনুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। মহানগর ওয়ার্কার্স পার্টির বিক্ষোভ-সমাবেশ থেকে তো মিনুকে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়।
এর আগে ২০১৯ সালের ১২ অক্টোবর রাজশাহী মহানগর বিএনপির এক বিক্ষোভ সমাবেশে মিনু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে তুলনা করে কটূক্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছিলেন। এ নিয়ে তখনও রাজশাহীতে বিক্ষোভ করে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করে বক্তব্য দেওয়ায় তাকে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। এরপর ফেসবুক লাইভে এসে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন সাবেক সিটি মেয়র মিনু।
এবার বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ এবং আরেকটি ১৫ আগস্টের ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দেওয়ায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। গত শুক্র ও শনিবার বিষয়টি নিয়ে তিনি কথা বলেন। মিনু সাহস নিয়ে প্রশ্নও তোলেন ওবায়দুল কাদের।
এদিকে, দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দেওয়ার পর মিনুর বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে জানতে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘এটা মিজানুর রহমান মিনুর একান্তই ব্যক্তিগত বক্তব্য। এ ব্যাপারে বিএনপি কী বলছে, আমরা সেটা শুনতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘মিজানুর রহমান মিনু অতীতে জঙ্গিবাদে মদদ দিয়েছেন। সেটা প্রমাণিত। তাই অতীতের মতো এখনও তিনি জঙ্গিবাদ কিংবা ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কিনা সে ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য অনুরোধ করছি।’