ভৈরবের ‘রক্তসৈনিক নজরুল’, রক্তদানে সেঞ্চুরি
১৯৯৯ সালে নিজের ১৮তম জন্মদিনে স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে শুরু। সেই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ১০০তম বার রক্তদানের রেকর্ড গড়েছেন ভৈরবের নজরুল ইসলাম (৪০)। তিনি ভৈরবে ‘রক্তসৈনিক নজরুল’ নামে পরিচিত।
নজরুল ২০০০ সাল থেকেঅসহায় মানুষের জীবন সংকটকালে স্বেচ্ছায় রক্তদানে অন্যকে উৎসাহিত করে রক্ত সংগ্রহ করছেন স্বেচ্ছায় রক্তদানে মানুষকে সচেতন করতে দেশব্যাপী ঘুরে বেড়াচ্ছেন কখনও বাইসাইকেলে করে, কখনও বা হেঁটে।
নিজ এলাকার অলিগলি আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রক্তদানে উৎসাহিত করতে বিনা মূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করছেন প্রায় নিয়মিত। এসব কাজের জন্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশাল এক স্বেচ্ছাসেবী কর্মীবাহিনী গড়ে তুলেছেন তিনি। মোবাইল ফোন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে চালিয়ে যাচ্ছেন এই মহান মানবসেবা।
এমন মানবতাবাদী কাজের জন্য মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসায় সব মহলে নজরুল আজ সিক্ত। প্রশংসা আর পুরস্কারের ঝুলি তাঁর কানায় কানায় ভরে উঠছে দিন দিন। প্রায়ই তাঁকে নিয়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে প্রতিবেদন।
নজরুলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ‘সন্ধানী’তে তিনি যান রক্ত দিতে। তার বয়স ১৮ বছর থেকে মাত্র দুই মাস কম হওয়ায় সংগঠনটি রক্ত নেয়নি। এতে তিনি মনে যেমন কষ্ট পান, তেমনি জেদও পুষেন।
ওই বছরের ২৮ নভেম্বর নজরুল ১৮ বছরে পদার্পণ করেন। রক্তদানের মাধ্যমে তার ১৮তম জন্মদিনকে স্মরণীয় করতে তিনি সেদিন চলে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। জীবনের প্রথম রক্তদান শুরু হয় তার সেদিন থেকে। এরপর থেকে তিনি চার মাস পর পর নিয়মিত রক্তদান করে যাচ্ছেন। গত মাসের (নভেম্বর) ৪ তারিখে রক্ত তিনি রক্তদানে সেঞ্চুরির মাইলফলক স্পর্শ করেন।
নজরুল জানান, স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়ে একটা সময় তিনি লক্ষ করেন—ঢাকা থেকে এসে অনেকে রক্ত সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। কিন্তু যাঁরা রক্ত দিচ্ছেন, তাদের তালিকা ঠিক মতো সংগ্রহে থাকে না এখানকার সংগঠকদের কাছে। ফলে স্থানীয় লোকজনের রক্তের প্রয়োজন হলে দাতাদের আর খোঁজে পাওয়া যায় না।
সেই ভাবনা মাথায় রেখে ২০০০ সাল থেকে নজরুল একটি খাতায় স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের নাম-ঠিকানা লিখে রাখা শুরু করেন। এলাকার হাসপাতালগুলোতে বলে রাখেন, জরুরি প্রয়োজনে তাদের কোনো রোগীর রক্তের প্রয়োজন হলে যেন তাকে জানানো হয়।
অন্যদিকে নজরুল হাসপাতালগুলোর সহায়তায় সাংগঠনিকভাবে পাড়া-মহল্লায় বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের ক্যাম্পিং শুরু করেন। সেই থেকে রক্ত দেওয়া-নেওয়ায় আরও সুগভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। যা বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী একটি শক্ত নেটওয়ার্কের উপর দাঁড়িয়েছে।
রক্তসৈনিক নজরুল শুধু একা নন, তার এই মহতী কাজের একান্ত সঙ্গী এখন তাঁর স্ত্রী আফসানা নাজনীন প্রিয়াও (২৭)। প্রিয়া বিয়ের পর থেকে ছয় বছর ধরে স্বেচ্ছায় রক্তদানে লোকজনদের উৎসাহিত করছেন। রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের বিভিন্ন ক্যাম্পিংয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন। কারও রক্তের প্রয়োজন হলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে রক্তের জন্য আহ্বান জানান। গ্রহীতার স্বজনদের সঙ্গে দাতার সমন্বয় করিয়ে দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রিয়া জানান, নজরুলের সঙ্গে তার পরিচয়, কথা-বার্তা, সম্পর্ক এবং বিয়ে-রক্ত বিষয়ক কাজের মাধ্যমেই। তিনি জানান, ২০১৩ সালে একজনের রক্তের প্রয়োজনে নজরুলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয় তার। এরপর দুই বছর কেটে যায়। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি তারা ফেসবুকে বন্ধু হন। ১৪ তারিখ থেকে ম্যাসেঞ্জারে প্রথম চ্যাট হয় এবং প্রিয়া তার ভালো লাগার কথা জানান নজরুলকে। ২৩ তারিখ তাদের পারিবারিক আয়োজনে বিয়ে হয়।
বর্তমানে সাড়ে ৪ বছরের ইসমাইল সিফাত নামের একমাত্র পুত্র সন্তানকে নিয়ে নজরুল-প্রিয়ার ছোট্ট সংসার। প্রিয়া জানান, ২০১৮ সালে তিনি প্রথমবার স্বেচ্ছায় রক্ত দেন। তবে ওজন কম থাকায় তিনি নিয়মিত রক্তদাতাদের তালিকায় নিজের নাম যোগ করতে পারেননি।
ভৈরবে গড়ে ওঠা প্রায় ৩০টির মতো প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রায়ই জটিল অপারেশনের রোগীদের জন্য রক্তের প্রয়োজন হয়। এখানে ব্লাডব্যাংক না থাকায় প্রয়োজনীয় রক্তের জন্য নির্ভর করতে হতো পেশাদার রক্তদাতাদের ওপর। আর এসব পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহে অনেক সময় সমস্যায় পড়তে হয়। অনেক সময় দেখা যায় তাদের কারো রক্তের হিমোগ্লোবিন কম, কারও বিরুদ্ধে মাদক সেবনের অভিযোগও আছে।
কিন্তু বর্তমানে নজরুলদের গ্রুপটি বিনামূল্যে স্বেচ্ছায় রক্তদানের কাজটি করায় রক্তের সমস্যাটা পুরোপুরি কেটে গেছে। যখনই তাদের কল করা হয়, রক্ত দিতে হাজির হয়ে যায় স্বেচ্ছায় রক্তদাতারা। এতে রোগীরা নির্ভেজাল রক্ত পাচ্ছে।
ভৈরবের বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা আজিজুল হক স্বপন নজরুলসহ তাদের পুরো টিমের জন্য শুভ কামনা জানান।