ভোলায় দাফন করা হবে মাজেদকে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদের ফাঁসি আজ শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে কার্যকর করা হয়েছে। তাকে তার গ্রামের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বাটামারা গ্রামে দাফন করা হবে। কারাগারে স্ত্রী সালেহা বেগম মাজেদের লাশ গ্রহণ করার জন্য রয়েছেন। পরিবারের অন্য সদস্যরাও সেখানে উপস্থিত আছেন। গভীর রাতে অ্যাম্বুলেন্সে করে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে লাশ ভোলায় পাঠানো হবে বলে কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
দণ্ড কার্যকরের সময় জেলা প্রশাসক, জেল সুপার, সিভিল সার্জন, আইজি প্রিজন উপস্থিত ছিলেন বলে কারাগারের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এর আগে জল্লাদ শাহজাহানের নেতৃত্বে একটি দল কনডেম সেলে প্রবেশ করে মাজেদের হাত বেঁধে যম টুপি পরিয়ে দেন। তার আগে তওবা পড়ান কারাগারে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম। রাত ১১টার দিকে তাকে তওবা পড়ানো হয়। এ সময় মাজেদ কান্নাকাটি করেন।
এর আগে আজ শনিবার রাত সোয়া ১১টায় কারাগারের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, সন্ধ্যার পর গোসল সারেন মাজেদ, তারপর রাত সাড়ে ৮টায় এশার নামাজ শেষ করেন। পরে তাকে শেষবারের মতো রাতে খাবার দেওয়া হয়। রাত সাড়ে দশটা সিভিল সার্জন প্রবেশ করেন। তারপর কারাগারে প্রবেশ করেন ঢাকা জেলা প্রশাসক ও কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজনস)।
গত সোমবার রাত ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের সামনে থেকে মাজেদকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ৪৪ বছর ৭ মাস ২১ দিন পর গ্রেপ্তার হন তিনি। সবশেষ গতকাল শুক্রবার স্ত্রীসহ পাঁচজন কারাগারে মাজেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফাঁসির আগে প্রত্যেক আসামিকে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়।
গত বুধবার ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এম হেলাল উদ্দিন চৌধুরী মাজেদের মৃত্যু পরোয়ানা জারির আদেশ দেন।
ওইদিন বিকেলে মাজেদ রাষ্ট্রপতির কাছে এ আবেদন করেন। কারা কর্তৃপক্ষ আবেদনটি বিকেলেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে বঙ্গভবনে পৌঁছানো হয়।
প্রাণভিক্ষার আবেদনটি বঙ্গভবনে পৌঁছার পরপরই তা খারিজ করে দেন রাষ্ট্রপতি। এটি প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় কারা কর্তৃপক্ষের সামনে দণ্ড কার্যকরে বাধা থাকছে না।
কে এই খুনি মাজেদ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার অন্যতম খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদ। স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যার পর অন্যসব খুনির মতোই ‘পুরস্কৃত‘ হন ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদ। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন চাকরিতে বহাল তবিয়তেই ছিলেন। কিন্তু ২৩ বছর পর ১৯৯৮ সালে এই চাঞ্চল্যকর মামলার রায় হওয়ার পর থেকেই ফেরার হন খুনি মাজেদ।
তবে শেষ রক্ষা হয়নি। এই পলাতক আসামিকে গত সোমবার রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে আজ মধ্যরাতে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
জানা গেছে, ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বাটামারা গ্রামের মরহুম আলী মিয়া চৌধুরীর ছেলে আব্দুল মাজেদ। তিনি চার কন্যা ও এক ছেলে সন্তানের জনক।তার স্ত্রী সালেহা বেগম।
এখনো পলাতক পাঁচ খুনি
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দায়ে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর মধ্যে ২০১০ সালে পাঁচ আসামির রায় কার্যকর করা হয়। আর আজ মধ্যরাতে কার্যকর হয় খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের ফাঁসি।
একজন খুনি পলাতক অবস্থায় মারা গেছেন বলে ধারণা করা হয়। ফলে আজকে রাতে মাজেদের ফাঁসির পর বাকি থাকলো আরো পাঁচ পলাতক আসামির ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল বিপথগামী একদল সেনা সদস্য। বিচারকাজ শেষে ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদ ও এ কে এম মহিউদ্দিনের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়।
পাঁচজনের ফাঁসির পর অন্য সাতজন পলাতক থাকেন। খুনিদের মধ্যে নূর চৌধুরী কানাডায় এবং এ এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন বলে সরকারের কাছে তথ্য রয়েছে। চেষ্টা করেও তাদের দেশে এনে রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি এখনও।
এ ছাড়া সরকারের তথ্য অনুযায়ী, খুনি আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন ২০০২ সালে।
পলাতক অন্য খুনি শরিফুল হক ডালিম, খন্দকার আবদুর রশিদ ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই কারোর।
বঙ্গবন্ধুকে খুনের পর পুরস্কৃত হন মাজেদ
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অন্য খুনিদের সঙ্গে ক্যাপ্টেন মাজেদ বঙ্গভবনে অবস্থান নেন। কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খানসহ আরো কয়েকজনের সঙ্গে মাজেদ তখন রেডিও স্টেশন নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্বে ছিলেন। এ সময় তিনি জেলখানায় জাতীয় চারনেতা হত্যাকাণ্ডেও জড়িত ছিলেন। জাতীয় চারনেতাকে হত্যার দায়েও মাজেদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
১৯৭৫ সালের নভেম্বরে দেশ ত্যাগের আগ পর্যন্ত অন্য খুনিদের সঙ্গে বঙ্গভবনে ‘বিভিন্ন দায়িত্ব’ পালন করে মাজেদ। পরে হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্য সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি ব্যাংকক হয়ে লিবিয়ায় চলে যান। তখনকার সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের নির্দেশেই তারা সেসময় নিরাপদে দেশ ছেড়ে যান বলে উল্লেখ করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
মাজেদ সেসময় লিবিয়ায় তিন মাস ছিলেন। এরপর ‘পুরস্কার হিসেবে’ তাকেসহ অন্য অনেককে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়। মাজেদকে চাকরি দিয়ে পাঠানো হয় সেনেগালের বাংলাদেশ দূতাবাসে।
১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ আবদুল মাজেদকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন করপোরেশনে (বিআইডব্লিউটিসি) চাকরি দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে উপসচিব মর্যাদায় তিনি বিআইডব্লিউটিসিতে যোগ দেন। পরে তাকে তখনকার যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের ‘ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট’ শাখার পরিচালক করা হয়। এরপর দেওয়া হয় তখনকার জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তরের পরিচালকের দায়িত্ব।
হত্যার ২১ বছর পর মামলা, ৪৫ বছর পর মাজেদের ফাঁসি
১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘদিন এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। এ ঘটনার ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালে মামলা দায়ের করা হয়।
এরপর ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বিচার প্রক্রিয়া শেষে ২৩ বছরের মাথায় ১৭১ পৃষ্ঠার রায়ে তৎকালীন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুলের আদালত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ১৮ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। বাকিদের খালাসের রায় দেন তিনি।
সবশেষ ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। তিনজনকে খালাস দেন। এর মধ্যে আব্দুল মাজেদও ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের ৪৫ বছর পর তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো।
রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাসায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ঘাতকরা। সেদিন ঘাতকদের নির্মম বুলেট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর সহধর্মিনী ফজিলাতুন নেসা, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাব-ইন্সপেক্টর ছিদ্দিকুর রহমান, পেট্রোল ডিউটির সৈনিক সামছুল হক ও রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলের প্রাণ কেড়ে নেয়।
ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতায় আসা তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’ জারি করে এ বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেন। হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’ বাতিল করে হত্যাকাণ্ডটির বিচারের পথ সুগম করে।
কেরানীগঞ্জ কারাগারে প্রথম ফাঁসি
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার জনবহুল পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড থেকে কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের পর এখনো পর্যন্ত সেখানে কোনো আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়নি। বঙ্গবন্ধুর খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকরই এই কারাগারের প্রথম ফাঁসি।