মাহাবুবুর রহমানের বৈদ্যুতিক ঢেঁকি সাড়া ফেলেছে যশোরে!
এক সময় পাড়ায় পাড়ায় দেখা মিলতো ঢেঁকি। সে সময় ঢেঁকিছাঁটা পুষ্টি সমৃদ্ধ চালের চাহিদাও ছিল ব্যাপক। এখন আর তেমন ঢেঁকির সন্ধান পাওয়া যায় না। এমনকি গ্রামের মা-বউদেরও একসঙ্গে ঢেঁকি পাড়ানোর দৃশ্য তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবে, এই ঢেঁকি ঘিরেই গ্রামের বউদের জটলা আবার চোখে পড়ল যশোরের একটি গ্রামে। পা ও গায়ের শক্তি ছাড়াই অটোমেটিক ঢেঁকি পাড়ানোর দৃশ্য দেখতে সেখানে ভিড় করছেন নারীরা।
ঢেঁকি শিল্পের ঐতিহ্যে প্রযুক্তির ছোঁয়া দিয়েছেন যশোর সদরের ফতেপুর ইউনিয়নের পশ্চিম চাঁনপাড়া গ্রামের মাহাবুবুর রহমান (৩৫)। তিনি উদ্ভাবন করেছেন বৈদ্যুতিক ঢেঁকি। যা ডিজিটাল ঢেঁকি নামে এলাকায় পরিচিতি লাভ করেছে। আর তার এই ডিজিটাল ঢেঁকিতে ধুম পড়েছে নতুন ধানের চাল ও আটা তৈরির।
ঢেঁকিছাটা চাল ও পিঠা-পুলির জন্য চালের গুঁড়া করতে দলে দলে আসছেন বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। আবার যাত্রাপথে থেমে দেখছেন পথচারীরাও। মাহাবুবুর রহমান দরিদ্র পরিবারে মানুষ হয়েছেন। ১০ বছর বয়স থেকে কাঠমিস্ত্রির পেশায় নিজেকে যুক্ত করেন। আর এই পেশাকেই কাজে লাগিয়ে তৈরি করেছেন পা দিয়ে চালিত অসংখ্য ঢেঁকি। পা দিয়ে চালিত ঢেঁকি তৈরি করতে করতে ভাবতেন এটা যদি যন্ত্রের মাধ্যমে চালিত করা যেত, তাহলে নারীদের কায়িক শ্রম কিছুটা লাঘব ও অর্থ সাশ্রয় হতো। আর যে চিন্তা সেই কাজ।
মাহাবুবুর রহমান গত তিন বছর আগে তৈরি করেন প্রথম বৈদ্যুতিক ঢেঁকি। কিন্তু প্রথম বার সেটা তেমন একটা টেকসই হয়নি। সাত-আট মাস হলো আবার নতুন করে আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরি করেন ডিজিটাল ঢেঁকি।
বৈদ্যুতিক সুইচ অন করলেই ঢেঁকিতে ধান ভাঙানো শুরু হচ্ছে। প্রাচীনকালে ধান থেকে চাল বের করা হতো ঢেঁকির এক প্রান্তে পা দিয়ে পালাক্রমে চাপ প্রয়োগ করে বা পাড় দিয়ে। আর এখন এ ঢেঁকিতে বিদ্যুতের মাধ্যমে মোটরচালিত লোহার হাতল দিয়ে পালাক্রমে চাপ দিয়ে ধানের তুষ ছাড়িয়ে চাল বের করা হয়। এতে সময় শ্রম ও ব্যয় হচ্ছে কম।
এছাড়া এই ঢেঁকির মাধ্যমেই প্রস্তুত করা হচ্ছে ঢেঁকিছাঁটা চাল। এ চালের ফাইবার নষ্ট না হওয়ায় পুষ্টিসমৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত হচ্ছে।
মাহাবুবুর রহমান জানান, নিজে এই প্রযুক্তির উদ্ভাবক হলেও তিনি ডিজিটাল ঢেঁকিতে ধান থেকে চাল করতে শ্রম দিচ্ছেন। এ কাজে তার স্ত্রী শাপলা খাতুন ও বৃদ্ধা মা সালেহা খাতুন সহযোগিতা করে থাকেন। এ ঢেঁকির মাধ্যমে দিনে পাঁচ থেকে ছয় মন ধান এবং ১০০ কেজি চাল থেকে গুঁড়া বানানো সম্ভব। ভবিষ্যতে ঘানির মাধ্যমে সরিষার তেল বানানোর জন্য নতুন কিছু তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। মৌসুমের সময় ৩০ হাজার টাকা মতো আয় হয়েছে। সামনে আবার মৌসুম এলে আয় ভালো হবে।
সরকারি সহযোগিতা বা কোনো ঋণ পেলে আরও এগিয়ে যেতে পারবেন বলেও জানান মাহাবুবুর রহমান।
চাঁনপাড়া গ্রামের বাসিন্দা খুলনা বিএল কলেজের ছাত্র আমিনুর রহমান বলেন, ‘আমাদের মা, বোন ও চাচিদের ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে ধান থেকে চাল বানাতে খুব কষ্ট হতো। রমজানের ছুটিতে বাড়িতে এসে দেখি মাহাবুবুর রহমান ভাই বিদ্যুতের সাহায্যে মেশিনের মাধ্যমে ঢেঁকি চালিয়ে ধান থেকে চাল ও চাল থেকে চালের গুঁড়া তৈরি করছেন। আর এটার জন্যই দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসছেন। নারীদের আগে অনেক কষ্ট হতো। এই আধুনিক প্রযুক্তির কারণে ঢেঁকিতে ছাটা চাল ও চালের গুঁড়া পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ ধরনের উদ্যোগ নিলে ঢেঁকিছাঁটা চাল ও চালের গুঁড়া মিলবে আগের মতোই। গ্রামীণ ঐতিহ্য পিঠা-পুলির সমারোহ থাকবে সারা বছর।’
স্থানীয় বাসিন্দা রিফাত বলেন, ‘মেশিনের ঢেঁকিতে চাল কোটায় অল্প সময় লাগছে। চাল ও চালের গুঁড়া করার জন্য প্রায় দিনই অনেককেই লাইন দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এখন দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসছে ঢেঁকিছাঁটা চাল ও চালের গুঁড়া করতে।’
চাঁনপাড়া গ্রামের গৃহবধূ মিতা বলেন, ‘আমাদের এই গ্রামে বৈদ্যুতিক ঢেঁকি স্থাপন হওয়ায় এলাকার নারীদের খুব সুবিধা হয়েছে। আমরা অনায়াসে চাল ও চালের গুঁড়া তৈরি করে নিচ্ছি। এই প্রযুক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা করা গেলে বাংলার নারীদের কষ্ট লাগব হবে।’
হেলেনা খাতুন নামে আরও এক নারী বলেন, ‘এই ঢেঁকি পায়ে চালিত ঢেঁকির চেয়ে অনেক ভালো। আমি নিজেই সেখান থেকে চালের গুঁড়া করে নিয়ে এসেছি। সেই গুঁড়া থেকে অনেক ভালো পিঠা হয়েছে। আর মিল থেকে কোটা গুঁড়া ভালো হয় না, যার কারণে পিঠা শক্ত হয়।’
নিজ গ্রামে এমন সুবিধা পাওয়ায় গ্রামের অনেক নারীরা দলে দলে চালের গুঁড়া করতে এখানে আসছেন বলেও জানান হেলেনা।
এ সম্পর্কে ফতেপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ সোহরাব হোসেন বলেন, ‘ঢেঁকির জায়গা দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন অটোরাইস ও হাস্কিং মিল। এ জন্য ঢেঁকিছাঁটা চাল কমই পাওয়া যায়। মাহাবুবুর নিজের চেষ্টায় প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজিটাল ঢেঁকি তৈরি করেছে। এজন্য এলাকার মানুষ পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল পাচ্ছেন। ইউনিয়ন পরিষদ তার এই ভালো উদ্যোগের সঙ্গে রয়েছে।’