মিরকাদিমের সাদা ও বুইট্টা গরু
কোরবানিতে পুরনো ঢাকার বাসিন্দাদের এক সময়ের পছন্দের মুন্সীগঞ্জ মীরকাদিমের ধবল (সাদা) গরু। ধলেশ্বরী ও ইছামতির তীরে অবস্থিত মুন্সিগঞ্জ সদরের মিরকাদিম পৌরসভা। ধলেশ্বরীর তীরবর্তী মিরকাদিমের একপাশে রয়েছে প্রাচ্যের ড্যান্ডি নারায়ণগঞ্জ। অপরদিকে রয়েছে ঢাকার কেরানীগঞ্জ।
পৃথক দুটি নদীর তীরবর্তী এ মিরকাদিমের ধবল ও বুইট্টা গরু কোরবানিতে পুরনো ঢাকাবাসীর কাছে বেশ প্রিয়। ঐতিহ্য ধরে রাখতে এ বছর ধবল ও বুইট্টা উভয় জাতের গরুর লালন পালনে বেশ আগ্রহ দেখা গেছে মিরকাদিমের খামারিদের।
ঈদ সামনে রেখে ধবল ও বুইট্টা গরু লালন পালনে এখন ব্যস্ত সময় কাটছে তাদের। ঢাকার রহমতগঞ্জের কোরবানির পশুর হাটেই মূলত মিরকাদিমের ধবল ও বুইট্টা জাতের গরুর পসরা বসে থাকে।
কোরবানির ঈদ উপলক্ষে সবেমাত্র এক সপ্তাহের জন্য ঢাকার রহমতগঞ্জ মাঠে (গণি মিয়ার হাট পুরনো নাম ) মিরকাদিমের সাদা গরু হাট বসে। অতীতে পাঁচ দিনে অন্তত তিন হাজার সাদা গরু বিক্রি হয়ে থাকলেও এখন শতাধিক গরু হাটে মিরকাদিম থেকে ঢাকার রহমতগঞ্জ মাঠে গিয়ে থাকে। মিরকাদিমের গরুর কদর ও দাম একটু বেশি। ৮০ হাজার টাকা থেকে ৮ লাখ টাকা গরুর মূল্য হয়ে থাকে। তবে মিরকাদিমের গরু মুন্সীগঞ্জের কোনো হাটে বিক্রি হয় না। ভারতের উরিষ্যা, জঙ্গলি, নেপালের নেপালি, ভুটানের বুইট্টা গরু মিরকাদিমে লালন পালন করে কোরবানি ঈদে বিক্রি করার জন্য। এখন আর মিরকাদিম জুড়েই এ গরু লালন পালনের চিত্র দেখা যায় না। তারপরও এ বছর অন্তত ডজনখানেক খামারি ধবল ও বুইট্টা গরু লালন পালন করে আসছেন।
সরেজমিনে মিরকাদিম পৌরসভার রামগোপালপুর ও এনায়েত নগর গ্রামে বুইট্টা ও ধবল গরু পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছে।
এদিকে, ক্রমাগত লোকসান ও গোখাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে অনেকে পেশায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় খামারের সংখ্যাও ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে। এক কথায় মিরকাদিমের ধবল গরু ও বুইট্টা গরু এখন বিলুপ্তির পথে। তাই ধবল গরুর পাশাপাশি নেপালি, হাঁসা, পশ্চিমা ও সিন্ধি জাতের গরু পাওয়া যায় মিরকাদিমে।
স্থানীয় খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশেষ কৌশলে পালন করায় এসব গরুর গোশত সুস্বাদু হয়। সাধারণত খৈল, ভুষি, খুদ ইত্যাদি খাওনো হয় এবং স্বাস্থ্য ভালো করার জন্য গরুগুলোর যত্ন নেয় খামার মালিকরা। তাই দাম ও চাহিদাও বেশি। পুরনো ঢাকার রহমতগঞ্জসহ রাজধানীর বড় বড় হাটগুলোতে এসব গরুর দেখা মিলবে কোরবানি হাটে। তবে কয়েক বছর ধরে পুরান ঢাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ীরা ঈদের কয়েক মাস আগেই চলে আসেন গরু কিনতে মিরকাদিমে। তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গরু পছন্দ হলেই ক্রয় করে ফেলে এবং ঈদ পর্যন্ত গৃহস্থদেরই গরু পালনের দায়িত্ব ও খরচ দিয়ে যায়। ফলে কোরবানির হাটে ওঠার আগেই অনেক গরু বিক্রি হয়ে যায়। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলো এখনও মিরকাদিমের গরু কোরবানিকে পারিবারিক ঐতিহ্য মনে করে থাকেন।
গরুর খামারিরা জানায়, অন্য অঞ্চলে বুইট্টা গরু পাওয়া গেলেও মিরকাদিমের বুইট্টা গরুর বৈশিষ্ট্য আলাদা। আকারে ছোট হলেও এই গরুর চেহারা দেখলেই বুঝা যাবে গোশতের সাধ কেমন হবে। এর বাহ্যিক অবয়ব খুব তেলতেলে ও গোলাকৃতির হয়। গোশত মোলায়েম ও সুস্বাদু। এছাড়া নেপালি গরুর উচ্চতা খুবই আকর্ষণীয়। সিন্ধি অনেক রঙের হলেও পশ্চিমা আর হাঁসা গরু সাদা রঙের। সাদা এসব গরুর উচ্চতা সবচাইতে বেশি। গরুর হাটে আকর্ষণ বৃদ্ধিতে এসব গরুর চাহিদা বেশ। সিন্ধি গরুর চাহিদা বিশ্বব্যাপী। সেটাও এখানে পাওয়া যায়।
তারা আরও জানান, এ কারণেই মিরকাদিমের গরুর চাহিদা অনেক। তাই কোরবানি ঈদের ছয় থেকে সাত মাস আগে থেকে তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছোট ও বাছাই করা গরু কিনে নিয়ে আসেন।
মিরকাদিম এগ্রোর মালিক মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘অনেক দিন এ পেশা থেকে সরে ছিলাম, এখন আবার গত দুই বছর ধরে নিয়মিত ভাবে গরু পালন করছি। সাদা বুইট্টা গরু এটা হলো চয়েজের ওপর বিক্রি। এটার দাম বলতে কিছু নেই। এটা শুধু চয়েজের ওপর বিক্রি করি। বুইট্টা গরু দেখতে অনেক সুন্দর আর এই সুন্দরের উপরেই দাম হাঁকানো হয়। তবে এক একটা বুইট্টা গরুর দাম ৮০ হাজারেও বেশি হয়ে থাকে। আমার খামারে আটটি বুইট্টা গরু রয়েছে। দেখি কত টাকা বিক্রি করতে পাড়ি। দাম ভালো পেলে আগামীতে আরও বেশি করে পালন শুরু করব।’
বিল্লাল হোসেন আরও বলেন, ‘আমার খামারে চার ধরনের গরু আছে। সাদা গরিয়ান, মিরকাদিমের গাবী সাদা ও সাইওয়াল লাল আছে। সাইওয়াল লাল ষাঁড়সহ অস্ট্রেলিয়ার করস মিলেই আছে। গত বছর আমাদের লোকশান গুনতে হয়েছে। এবারও করোনার প্রভাব বেশি। জানি না কি হয়। যদি ইন্ডিয়া থেকে গরু না আসে তাহলে আমাদের লোকশান গুনতে হবে না। গোখাদ্যের যে হারে দাম এতে গরু লালন পালন শেষে কিছুই থাকছে না। আমার খামারে নিয়মিত আটজন লোক কাজ করছে।’
খামারি ইমন বেপারী বলেন, ‘মিরকাদিমের ঐতিহ্য হলো ধবল ও বুইট্টা গরু এবং মিরকাদিমের হাফসা। আমাদের মিরকাদিমে আগে প্রচুর খামারি বুইট্টা ও ধবল গরু লালন পালন করতেন। ধীরে ধীরে খামারিরা অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছে। কারণ লোকশান হলে অনেক টাকা ঋণের তলে পড়তে হয়।
ইমন আরও বলেন, ‘এবারও করোনার কারণে গরু বিক্রি নিয়ে অতঙ্কে রয়েছি। যদি লগডাউন বেশি পরিমাণের দেওয়া হয় তাহলে আমাদের অনেক সমস্যা হবে। আমার খামারে ৭০টি গরু রয়েছে। এর মধ্যে বুইট্টা গরু রয়েছে ২০টি। ধবল রয়েছ ৩০টির মতো। আমরা দুই ভাই মিলে গরু পরিচর্যা করি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন ঈদকে সামনে রেখে লগডাউন সীমিত করে দিবেন। না হয় এবার লোকশান গুনলে আমরা শেষ হয়ে যাব। গত বছর করোনার কারণে লোকশান গুনতে হয়েছে।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. কুমুদ রঞ্জন মিত্র জানান, মিরকাদিমের গরু সারা দেশে সুপরিচিতি রয়েছে। মিরকাদিমের লোকজন দেশের বিভিন্ন স্থান হতে সাদা গরুগুলো সংগ্রহ করে। এবং তারা ঈদ পূর্ববর্তী সময়ে লালন পালন করে। এবং ঈদে রহমতগঞ্জ হাটসহ বিভিন্ন হাটে বিক্রি করে। এই গরুর খুব চাহিদা আছে কিন্তু ইদানিং গোখাদ্যের দামের জন্য অনেকে খামারি পালতে অনীহা প্রকাশ করছে। এজন্য প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে আমরা খামারিদের সার্বিক সহযোগিতা করছি। কীভাবে কম খরচে প্রাকৃতিকভাবে মোটাতাজা করতে পারে সে ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এতে খামারি কম খরচে লাভবান হতে পারবে। অনেক খামারি আমাদের পরামর্শ নিয়ে গরু পালন করছে। এতে আবারও মিরকাদিমের গরুর হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।’