‘মেয়েকে মেডিকেলে পড়ানো আমার কাছে দুঃস্বপ্ন’
‘সংসার চালানোই যেখানে দায়, সেখানে মেয়ের মেডিকেলে লেখাপড়ার খরচ চালানো আমার কাছে দুঃস্বপ্ন।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাগুলো বলেন পাবনার সুজানগর উপজেলার গরিব ভ্যানচালক বাকীবিল্লাহ।
এবার দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন বাকীবিল্লাহর মেয়ে মোছা. জান্নাতুম মৌমিতা মুন্নী। কিন্তু অর্থের অভাবে মেডিকেলে ভর্তি হওয়া অনিশ্চত হয়ে পড়েছে তাঁর।
মুন্নীর বাবা বাকীবিল্লাহ আরও বলেন, ‘ব্র্যাকের স্থানীয় শাখা থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি ভ্যান কিনি। সেই ভ্যান চালিয়ে দিনে যে দুতিনশ টাকা আয় হয় সেটা দিয়েই কোনোরকম পরিবারের ছয় সদস্যের মুখের আহার তুলে দেই। তবে স্বপ্ন দেখি আমার মেয়ে ডাক্তার হবে। কিন্তু টাকার অভাবে মেয়েকে ভর্তি করাতে পারব কিনা জানি না।’
মুন্নী জানান, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস কোর্সের প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের মধ্যে তিনি পেয়েছেন ৬৯ দশমিক ৭৫ নম্বর। শিক্ষাজীবন জুড়েই আর্থিক দুশ্চিন্তা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিল মুন্নীর। মেধার জোরে সব বাধাকে জয় করে মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু সেই আর্থিক দুশ্চিন্তাই তাঁকে ঘিরে ধরেছে।
জান্নাতুম মৌমিতা মুন্নী পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার তাঁতীবন্দ ইউনিয়নের উদয়পুর গ্রামের দরিদ্র ভ্যানচালক বাকীবিল্লাহ ও গৃহিনী মা রওশন আরা খাতুনের মেয়ে। চার সন্তানের মধ্যে মুন্নী বড়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মুন্নীর বাবা। শুধু বাড়ির দুই কাঠা জায়গাই সম্বল। এ ছাড়া তেমন কিছুই নেই।
বাড়িতে ছোট টিনের একটি ঘরেই থাকেন পরিবারের সবাই। মুন্নীর বাবার ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। সেখানে মেডিকেলে ভর্তি ও পড়ালেখার খরচ জোগানো তাঁর পক্ষে অসম্ভব।
মুন্নী ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী। তিনি পোড়াডাঙ্গা হাজী এজেম আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। ছোট থেকেই তাঁর ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। তিনি অধিকাংশ সময়ই লেখাপড়ার পেছনে ব্যয় করেছেন। স্বপ্ন পূরণের এতো কাছে এসেও টাকার অভাবে স্বপ্ন ভেঙে যাবে তা মেনে নিতে পারছেন না মুন্নী।
মুন্নী বলেন, ‘স্কুল-কলেজে পড়াশুনার সময় অর্থের অভাবে একসঙ্গে প্রয়োজনীয় সব বই কিনতে পারতাম না। একটা একটা করে বই কিনতাম। মন চাইলে একটা ভালো পোশাক কিনতে পারতাম না। মেডিকেলে সুযোগ পাওয়ার পর এখন খুব চিন্তা হচ্ছে। মেডিকেলের বইয়ের দাম বেশি। দিনাজপুরে পড়াশুনা করতে গিয়ে সেখানে থাকা-খাওয়াসহ অনেক খরচ হবে। এত টাকা আমার হতদরিদ্র বাবা কোথায় পাবে? কীভাবে পড়ালেখার খরচ চালাব বুঝতে পারছি না। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি আকুল আবেদন জানাচ্ছি। তিনি যেন আমার লেখাপড়া চালানোর দায়িত্ব নেন।’
সবার সহযোগিতায় পড়াশুনা সম্পন্ন করে ভালো একজন চিকিৎসক হয়ে দেশ ও দেশের পিছিয়েপড়া মানুষের জন্য সারা জীবন কাজ করে যেতে চান মুন্নী।
পোড়াডাঙ্গা হাজী এজেম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘১৯৮৪ সালে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলেও বিগত ৩৬ বছরে এই বিদ্যালয় থেকে কোনো শিক্ষার্থী সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পায়নি। কিন্তু এবারে দরিদ্র পরিবারের এই অত্যন্ত মেধাবী মেয়ে মুন্নী সে সুযোগ পাওয়ায় আমরা গর্বিত। সে আমাদের বিদ্যালয়সহ ইউনিয়নবাসীর মুখ উজ্জ্বল করেছে।’
ওই শিক্ষক আরও জানান, মুন্নী দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলেও সে অত্যন্ত মেধাবী একজন ছাত্রী। প্রশাসনসহ সমাজের বিত্তবানরা নজর দিলে মুন্নীর মেডিকেলে পড়া আটকাবে না।’