রাজশাহীতে আজ থেকে বিধিনিষেধ, সংক্রমণ না কমলে কঠোর লকডাউন
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের দুটি পিসিআর ল্যাবে গতকাল রোববার ৪৭৭ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৯৭ জনের করোনা পজিটিভ এসেছে। শনাক্তের হার ৪১ দশমিক ৩০ শতাংশ। করোনার এই ঊর্ধ্বগতিতে জেলায় বাড়ানো হয়েছে বিধিনিষেধের সময়। প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে পরদিন সকাল ৬টা পর্যন্ত নগরীতে ওষুধের দোকান ছাড়া সব ধরনের ব্যাবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং একই সময়ে লোকজনের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। আজ সোমবার থেকে আগামী পাঁচ দিন এই বিধিনিষেধ পর্যবেক্ষণ করা হবে। সে অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
এ ছাড়া করোনার হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ সংলগ্ন রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর ও মোহনপুর উপজেলার কোনো বাসিন্দা নগরীতে প্রবেশ করতে পারবে না বলে জানিয়েছে প্রশাসন। গতকাল রোববার বিকেলে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে রাজশাহীর করোনা পরিস্থিতি নিয়ে এক জরুরি সভা শেষে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এসব তথ্য জানান।
মেয়র আরও জানান, আগামী পাঁচ দিন এই বিধিনিষেধ চলবে। এর মধ্যে করোনার সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার না কমলে ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হবে।
এদিকে, কমিউনিটি পর্যায়ে করোনার সংক্রমণ কতটা ছড়িয়ে পড়েছে, তা জানতে গতকাল রোববার থেকে নগরীর পাঁচটি স্পটে র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে বিনামূল্যে ভ্রাম্যমাণ করোনা টেস্ট শুরু হয়েছে। মহানগর পুলিশের সহযোগিতায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ওই সব স্থানে সকাল ১০টা থেকে ভ্রাম্যমাণ করোনা টেস্ট ক্যাম্প বসিয়ে জনসাধারণের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রথম দিন ২৮৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২৭ জনের করোনা পজিটিভ এসেছে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. কাইউম তালুকদার। তিনি জানান, ভ্রাম্যমাণ করোনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ছিল ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
প্রথম দিন নগরীর সাহেববাজারে ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্পে ৮৪ জনের নমুনা পরীক্ষার পর ছয়জনের করোনা পজিটিভ এসেছে। এ ছাড়া হড়গ্রাম বাজারে ৩৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে পাঁচজন, সিএন্ডবি মোড়ে ৫৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করে তিনজন, লক্ষ্মীপুর মোড়ে ৫০ জনের নমুনা পরীক্ষা করে আটজন এবং তালাইমারী মোড়ে ৬৪ জনের নমুনা পরীক্ষার পর পাঁচজনের করোনা পজিটিভ এসেছে। এসব এলাকার মধ্যে লক্ষ্মীপুর এলাকায় সংক্রমণ বেশি।
সিভিল সার্জন বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্পে ফ্রি করোনা টেস্ট করতে জনগণের আগ্রহ আছে। প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২০০ জনের টেস্ট করার পরিকল্পনা আছে। তবে জনবল সংকটের কারণে ঠিক বলা যাচ্ছে না আগামীতে এই কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া যাবে কি না। আমরা রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলব।’
এর আগে আজ সোমবার সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস জানিয়েছেন, ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালের আইসিইউ ও করোনা ওয়ার্ডে আরও সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে তিনজন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা। অন্য চারজন রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও পাবনা জেলার বাসিন্দা। এ ছাড়া হাসপাতালে নতুন করে করোনায় আক্রান্ত ২০ জন ভর্তি হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১৬ জনই রাজশাহী জেলার। অন্য চারজনের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনজন ও নওগাঁর একজন রয়েছে। এ নিয়ে হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি আছে ২৩২ জন। আর আইসিইউতে আছে ১৮ জন।
করোনার এই ঊর্ধ্বগতিতে করণীয় সর্ম্পকে গতকাল রোববার দুপুরের পর জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিলের সভাপতিত্বে সভায় সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. হুমায়ুন কবীর, রাজশাহী রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি আব্দুল বাতেন, মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আবু কালাম সিদ্দিক, পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন, রামেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস, সিভিল সার্জন ডা. কাইয়ুম তালুকদারসহ বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ডাবলু সরকারসহ ১৪ দলের নেতা ও নগরীর ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা অংশ নেন।
প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক শেষে সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন জানান, আগামী পাঁচদিন বিকেল ৫টা থেকে পরদিন সকাল ৬টা পর্যন্ত নগরীতে সব ধরনের দোকানপাট ও বিপণিবিতান বন্ধ থাকবে। একই সঙ্গে লোকজনের চলাচল বন্ধ থাকবে। সন্ধ্যার পর থেকে নগরীতে থ্রি হুইলার রিকশাও চলতে পারবে না। আজ সোমবার থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে। এ ছাড়া সভায় লোকজনকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রচার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
মেয়র বলেন, ‘মানুষের জীবন-জীবিকাও দেখতে হবে। এ সময় সব বন্ধ করে দিলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়বে। বিশেষ করে আম চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হবে। তবে আগামী পাঁচ দিন আমরা রাজশাহীর করোনা পরিস্থিতি দেখব। এরপর যদি করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে সভা করে ১৪ দিনের কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
এদিকে, রামেক হাসপাতালে কেরোনা রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় রাজশাহীতে নতুন করে ১০০ শয্যার করোনা হাসপাতাল চালুর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রামেকের ডেন্টাল ইউনিটটিকে সংস্কার করে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সার্ভিস দিয়ে করোনা হাসপাতাল হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এটি এক সময় রাজশাহী সদর হাসপাতাল হিসেবে চালু ছিল।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘করোনাভাইরাস নিয়েই আমাদের থাকতে হবে। তাই একটি সম্পূর্ণ করোনা হাসপাতাল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে কয়েক দফায় কথা হয়েছে। তারাও এতে রাজি আছে। আমাদের প্রস্তাবনা পাঠাতে বলা হয়েছে। সেটি তৈরির কাজ চলছে। সেন্ট্রাল অক্সিজেন সার্ভিস, চিকিৎসক ও জনবল কাঠামোর প্রস্তাবনাও পাঠানো হবে।’
হাসপাতাল পরিচালক আরও বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব আমরা এ হাসপাতালটি চালু করতে চাই। তবে অবকাঠামো নির্মাণ করে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সেন্টার বসাতে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগে। এর আগে আমরা হাসপাতালে আরও একটি করোনা ওয়ার্ড চালু করতে চাই।’
১৯০২ সালে ব্রিটিশদের নির্মিত বর্তমানের রামেকের ডেন্টাল ইউনিট ভবনেই প্রথম শুরু হয়েছিল রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। ধীরে ধীরে মেডিসিন, নাক-কান-গলা, হাড় জোড়া এমনকি অস্ত্রোপচার সেবাও চালু হয়, যা ১৯৩৮ সালে রূপ পায় সদর হাসপাতালে। রামেক হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় সদর হাসপাতালের কার্যক্রম। অথচ এক সময় এই হাসপাতালটিই ছিল এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসা। রাজশাহীতে করোনা রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় জনস্বার্থে সদর হাসপাতালটি আবারও চালুর দাবি করেছেন চিকিৎসকসহ সচেতন মহল।