রাজশাহীতে করোনায় শ্রমজীবীরাও আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে তরুণরাও
‘করোনা উচ্চবিত্তের অসুখ, যারা এসি রুমে থাকে, তারাই আক্রান্ত হয় এ রোগে।’ বেশিরভাগ সাধারণ মানুষই এমন ধারণা পোষণ করেন। তাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে রাজশাহীতে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে নিম্নআয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। এমনকি গ্রামের মানুষও আক্রান্ত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে তরুণ-যুবকরাও।
দেশে করোনার অন্যতম হটস্পট এখন রাজশাহী। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে নগরীতে চলছে লকডাউন। এরপরও রাস্তায় রয়েছে নিম্নআয়ের শ্রমজীবীরা। করোনায় তারাও যে আক্রান্ত হতে পারে, এমন আশঙ্কা করেন না তাঁরা।
এমন একজন মাসুদ। বয়স ২৮। পেশায় ভ্যানচালক। নগরীর বোয়ালিয়া থানার মোড়ের একটি কুরিয়ার সার্ভিসে আসা মালামাল পৌঁছে দেন প্রাপকের ঠিকানায়। মুখে মাস্ক না পরে পকেটে ভাঁজ করে রাখেন। প্রশাসন কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাউকে দেখলেই নিমিষেই পকেট থেকে মাস্ক চলে যায় মুখে। কেন এমন লুকোচুরি? জানতে চাইলে মাসুদ বলেন, ‘পরিশ্রমের কাজ করি। মুখে মাস্ক রাখতে পারি না। ঘেমে যাই। মাস্ক ভিজে যায়। পুলিশের ভয়ে মাস্ক পকেটে রাখি, যদি জরিমানা করে।’
করোনার ভয় নেই? এমন প্রশ্নে বেশ জোরেই তিনি বলেন, ‘আমাদের করোনা হবে না। আমরা কষ্ট করি। রোদে ভ্যান চালাই। যারা এসি রুমে থাকে, তাদের করোনা হবে। যারা শান্তিতে আছে, তাদের করোনা হবে।’
নগরীর কুমারপাড়া এলাকার একটি গলিতে দেখা হয় রিকশাচালক মালেকের সঙ্গে। বাড়ি নওগাঁর মান্দায়। থাকেন নগরীর হাদির মোড় এলাকার একটি রিকশা গ্যারেজে। লকডাউন চললেও বের হয়েছেন রিকশা নিয়ে। নগরীর প্রধান রাস্তাগুলোতে যাচ্ছেন না। রিকশা দেখলেই টায়ার ফুটো করে দেয় পুলিশ। তাই পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে রিকশা চালাচ্ছেন নগরীর অলি-গলিতে। গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন মাস্ক। দেখেই বোঝা যায় বহুদিন ব্যবহার করেছেন। ময়লার আস্তরণ জমে গেছে মাস্কে। পুলিশ না দেখলে মাস্ক পরার প্রয়োজন মনে করেন না। আবার কোনো কোনো যাত্রী মাস্ক ছাড়া রিকশায় উঠতে না চাইলে তখন মাস্ক পরেন।
করোনা কাদের হয়? জানতে চাইলে মালেক বলেন, ‘বেশিরভাগ ভদ্র লোকেরই করোনা হয়।’
উল্টো প্রতিবেদককে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘সাধারণ গরির মানুষ বা একটা রিকশাচালককে দেখান তাঁর করোনা হয়েছে। আমরা সারাদিন রোদে পুড়ি, ঘামে ভিজে রিকশা চালাই। আমাদের করোনা হয় না। বড়লোকদেরই বেশি সমস্যা।’
করোনা নিয়ে রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলতে দেখে রুবেল নামের এক পথচারী এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘গত প্রায় দেড় বছরে টিভি, পেপার-পত্রিকা, ফেসবুকে দেখলাম না খেটে খাওয়া মানুষের করোনা হয়েছে। বাড়ির আশেপাশে এ পর্যন্ত এই রোগে যে কজন আক্রান্ত হয়েছে, তাঁরা বড়লোক। এসিতে থাকেন। আমরা সাধারণ মানুষ, এই রোগে মরব না।’
শ্রমজীবী এবং নিম্নমধ্যবিত্ত এসব মানুষের ধারণা ভুল প্রমাণ করে করোনায় আক্রান্ত নিম্ন আয়ের অনেকেই এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসা নিচ্ছেন গ্রামের মানুষও। তাদের সবাইকে এখন অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম ইয়াজদানী।
শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘এবারে করোনার যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, সেটি কাউকে মানছে না। হাসপাতালে আগে আমরা দেখেছি গ্রামের কেউ করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসেননি। নিম্ন আয়ের মানুষের দেহে আগে করোনাভাইরাস ছিল না। এখন হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডগুলোতে যারা ভর্তি আছে, তাদের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ গ্রামের মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ। আগে এই শ্রেণির মানুষ করোনায় আক্রান্ত হতোই না। এই শ্রেণির মানুষ এখনও মনে করেন, তাদের করোনা হয় না। ফলে তাঁরা নিজেদের ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ায়। মাস্ক পরে না। স্বাস্থ্যবিধি মানে না।’
হাসপাতাল পরিচালক বলেন, ‘করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট কাউকেই ছাড়ছে না। উচ্চবিত্ত বা একেবারে নিম্নবিত্ত হোক, যে বয়সেরই হোক, সবাইকে এখন সচেতন হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে। না মানলে আমরা নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনব।’
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘শ্রমজীবী মানুষের পাশাপাশি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে তরুণ ও যুবকরা। আগে সাধারণ বেশি বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতো। এই ধারাও পরিবর্তন হচ্ছে। যারা কম বয়সী তারাও আক্রান্ত হচ্ছে। চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে করোনা ও উপসর্গ নিয়ে এই হাসপাতালে মারা গেছে ১৪৮ জন। গত মঙ্গলবার সকাল থেকে আগের ২৪ ঘণ্টাও মারা যাওয়া ১২ জনের মধ্যে তিনজনই তরুণ, যাদের বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।’
এদিকে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১১টি ওয়ার্ডকে করোনা ওয়ার্ডে রূপান্তর করেও রোগীর চাপ সামাল দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। ২০টি আইসিইউ বেডসহ কোভিড রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৩০৯টি বেডের বিপরীতে বুধবার পর্যন্ত রোগী ভর্তি ছিল ৩৪৪ জন। স্থান সংকুলান না হওয়ায় অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন নেই, এমন করোনা আক্রান্ত রোগীকে আর ভর্তি করা হচ্ছে না রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।