রাত গভীর হলেই ঘুরে ঘুরে সেহেরি বিতরণ

পাবনা সদর হাসপাতালের সামনের একটি ওষুধের দোকানে কাজ করেন সাইদুর রহমান (৫০)। সারা রাত দোকানদারি করতে হয়। সেহরি খাওয়ার জন্য বাসায় যাওয়া কষ্টকর। তাই কোনো কিছু খেয়ে রোজা রাখেন।
পাবনা শহরের একটি মার্কেটে নৈশপ্রহরী হিসেবে কাজ করেন জমসেদ উদ্দিন (৫৮)। করোনা মহামারিতে রাতের রাস্তা ফাঁকা থাকলেও তাঁকে পাহারার কাজ করতেই হয়। রমজান মাস শুরু হওয়ার পর থেকে বিপদে পড়েছেন জমসেদ। কারণ রাতে সবকিছু বন্ধ থাকায় সেহেরির সময় খাবার পাওয়াটা প্রায় দুষ্প্রাপ্য। না খেয়ে হলেও রোজা থাকেন তিনি।
শেষ রাতে সেহেরিতে কী খাবেন এই ভাবনায় তারা যখন বিভোর এমন সময় মাঝ রাতে কয়েকজন যুবক সাইদুর রহমান ও জমসেদ উদ্দিনের কাছে ছুটে যান, সেহেরির জন্য তাঁদের হাতে তুলে দেন এক প্যাকেট খাবার। খাবারের প্যাকেটটি হাতে পেয়ে সাইদুর ও জমসেদের দুশ্চিন্তা দূর হয়, সেইসঙ্গে হৃদয়ের গভীর থেকে এই তরুণদের জন্য কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন তিনি।

রোজার মাসে শেষ রাতে সেহেরির খাবার জোগান দিতে এভাবেই সাইদুর ও জমসেদের মতো খেটে খাওয়া হতদরিদ্র শ্রেণির মানুষের মধ্যে এবং রাস্তার ছিন্নমূল মানুষের জন্য খাবারের প্যাকেট নিয়ে মাঝ রাতে ছুটে যান পাবনা শহরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশনের কয়েকজন তরুণ।
পবিত্র রমজানের পঞ্চমদিন থেকে প্রতিদিন মধ্যরাতে দুই শতাধিক অসহায় মানুষের মধ্যে সেহেরি বিতরণ করছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতি রাতে দুটো অটোরিকশায় করে ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক দেওয়ান মাহবুবুল ইসলামের নেতৃত্বে ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকেরা হাসপাতালসহ শহরের নানাস্থানে অসহায় মানুষদের মধ্যে এ খাবার বিতরণ করছেন।
করোনা মহামারিতে কর্মহীন মানুষ, খেটে খাওয়া দরিদ্র শ্রেণির মানুষ, এবং মহামারিতে কর্মহীন হয়ে পড়া কম আয়ের মানুষের মধ্যে প্রতিদিন রাতে এ খাবার বিতরণ করা হচ্ছে বলে জানান সংগঠনের কর্মকর্তারা। সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকেরা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে অসহায় ছিন্নমূল মানুষ, রোগী ও তাদের সঙ্গে থাকা স্বজন, নৈশপ্রহরী, রিকশাচালক, রাস্তায় থাকা মানসিক রোগীসহ ভাসমান মানুষদের মধ্যে খাবার বিতরণ করছে।

তাদের খাদ্য তালিকায় দেওয়া হচ্ছে কোনোদিন সাদা ভাত, মুরগির মাংস, সবজি ও ডাল। আবার কোনোদিন সাদা ভাত, মাছ, সবজি ও ডাল। কোনোদিন আবার খিচুড়ি ও ডিম ভুনা। এ খাবার হাতে পেয়ে করোনা আর লকডাউনের এই দুঃসময়ে খুবই খুশি অসহায় সাধারণ মানুষ।
পাবনা শহরের সাধুপারা এলাকার রাতের রিকশাচালক আমজাদ হোসেন বলেন, রাতের বেলায় রিকশা চালানোর জন্য বের হলেও লকডাউনের কারণে রাস্তায় গাড়ি না থাকায় খুব একটা যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। যাত্রী না পেলেও কাজ ছেড়ে বাড়ি চলে যেতে পারি না। যাত্রীর অপেক্ষায় রাতভর শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে বেড়াই। ফলে সময়মতো সেহেরি খাওয়া হয় না। তরুণদের দেওয়া খাবারের প্যাকেট হাতে পেয়ে দুশ্চিন্তা দূর হয়েছে।
পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, ইন্দিরা মোড়, ট্রাফিক মোড়, হাসপাতাল গেট ও টার্মিনালের কাছে খাবারের গাড়িগুলো দাঁড়ানোর পর যারা লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারে না, তাদেরকেই দেখা গেছে তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশনের এই সেহেরির খাবারের গাড়ি থেকে খাবার নিতে।

তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক দেওয়ান মাহবুবুল ইসলাম বলেন, শুভানুধ্যায়ীদের দানে মানবকল্যাণী এই কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তাঁরা। এই অসময়ে এসব অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করতে পেরে তাঁরা আনন্দিত। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত তাঁরা এই কার্যক্রম চালাবেন। করোনা মহামারির এই কঠিন সময়ে অসহায় মানুষের পাশে থাকতে পুরো রোজার মাসে এ কর্মসূচি চলবে বলে জানান তিনি।
তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশনের এ কর্মকাণ্ডকে সাধুবাদ জানিয়ে পাবনা প্রেসক্লাবের সম্পাদক সৈকত আফরোজ আসাদ বলেন, সমাজের অন্যরা যদি এভাবে এগিয়ে আসে, তাহলে সমাজের অনেক বড় বড় সমস্যা সহজে সমাধান করা সম্ভব।