রিফাত হত্যার রায় : আদালতের আদ্যোপান্ত
বরগুনার বহুল আলোচিত মো. শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফ (২৬) হত্যা মামলায় তাঁর স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয় আসামির ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। খালাস পেয়েছেন চারজন। বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান আজ বুধবার দুপুরে এ রায় ঘোষণা করেন।
রায় ঘোষণা উপলক্ষে সকাল ৮টা থেকে আদালতপাড়া পুলিশ, সাংবাদিক, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থীদের পদচারণায় মুখরিত ছিল। গোটা শহর ছিল থমথমে। মামলার ১০ আসামির মধ্যে জামিনে ছিলেন আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি। সকাল ৯টায় বাবার সঙ্গে তিনি বরগুনা দায়রা জজ আদালতে উপস্থিত হন। এরপর শুরু হয় অপেক্ষা।
রায়ের অপেক্ষায় ৪ ঘণ্টা
বাবার সঙ্গে এসে মিন্নি আদালতের সামনে বারান্দায় অপেক্ষা করতে থাকেন। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মিন্নি সেখানেই বসে বাবার সঙ্গে গল্প করে সময় কাটান। তিনি সাদা জামা ও ওড়না পরিহিত ছিলেন। মাঝে মধ্যে তাকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। বেলা ১১টার দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে মামলার অপর আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে এসে গারদে রাখা হয়।
গণমাধ্যমের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কারণে রায়কে ঘিরে আদালতের ভেতরে সাংবাদিকদের প্রবেশে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। সকাল থেকে ঢাকার ও স্থানীয় শত শত সাংবাদিক আদালত চত্বরে এসে জড়ো হন। কিন্তু সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। শুধু বরগুনার স্থানীয় তিনটি সাংবাদিক সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে তিনজনকে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন বরগুনা টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি ও এনটিভির নিজস্ব প্রতিনিধি সোহেল হাফিজ, বরগুনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর মো. সালেহ ও সাংবাদিক ইউনিয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস খান ইমন। এর বাইরে ঢাকা থেকে নিউজ সংগ্রহে আসা এনটিভি অনলাইনের সিনিয়র করেসপনডেন্ট জাকের হোসেনকে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়।
রায় ঘোষণা ও বিচারকক্ষের পরিবেশ
কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রায়ের আগে আদালতের এজলাসকক্ষে প্রবেশ করানো হয় নির্ধারিত আইনজীবী ও চারজন সাংবাদিককে। বেলা পৌনে ১টায় এ মামলার আট আসামিকে আদালতের কাঠগড়ায় নেওয়া হয়। তবে জামিনে থাকা আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে এজলাসের সামনে নেওয়া হয় দুপুর ১টার দিকে। তাঁকে দুই পাশ থেকে দুজন নারী পুলিশ সদস্য ধরে রাখেন। পিনপতন নীরবতা নেমে আসে তখন আদালতকক্ষে। সবাই রায়ের অপেক্ষায় থাকে।
দুপুর সোয়া ১টার দিকে এজলাসে আসেন বিচারক। বিচারকের সামনের কয়েকটি বেঞ্চে শুধু তালিকাভুক্ত আসামিদের আইনজীবীরা বসেছিলেন। তাদের পিছনে পুলিশি নিরাপত্তায় দাঁড়ানো ছিলেন মিন্নি। তাঁর পেছনে কাঠগড়ায় ছিলেন আট আসামি। লোহা ও কাঁচে ঘেরা কাঠগড়ায় আসামিরা দাঁড়িয়ে ছিলেন।
বিচারক এজলাসে উঠে বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে বসেন সবাই।’ এরপর তিনি আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ রায় লিখেছি। তবে আপনারা চাইলে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করতে পারি।’
এরপর আদালত সোয়া ১টায় রায় পড়া শুরু করেন। রায়ে প্রথমে মামলার এজাহার এবং পরে আসামিদের অপরাধের বর্ণনা পড়ে শুনান বিচারক। এরপর তিনি রায়ের পর্যবেক্ষণ পড়েন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, ‘আসামি রিফাত ফরাজী, রাব্বি আকন, সিফাত, টিকটক হৃদয়, মো. হাসান ও মিন্নি পূর্বপরিকল্পিতভাবে রিফাত শরীফকে হত্যা করে পেনাল কোডের ৩০২ ও ৩৪ ধারায় অপরাধ করেছে।’
আদালত বলেন, ‘প্রকাশ্য দিবালোকে সনাতনী অস্ত্র ও রামদা দ্বারা কোপাইয়া সংঘটিত এই মামলার নির্মম হত্যাকাণ্ড মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানাইয়াছে। উক্ত নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটনকারী আসামিরা প্রত্যেকে যুবক। তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে যুবসমাজসহ দেশ–বিদেশের সব বয়সের মানুষ তাহাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া দেশের যুবসমাজ ভুল পথে অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কা থাকিবে। তাই আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়।’
এরপর আদালত মূল রায় ঘোষণা করেন। রায়ে প্রথমে ১০ আসামির মধ্যে মিন্নিসহ ছয়জনকে ফাঁসির আদেশ দেন। তাঁরা হলেন- রাকিবুল হাসান রিফাত ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩), আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), মো. রেজওয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), মো. হাসান (১৯), আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি (১৯)।
এরপর আদালত চার আসামিকে খালাসের ঘোষণা দেন। তাঁরা হলেন- মো. মুসা (২২), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), মো. সাগর (১৯) ও কামরুল হাসান সাইমুন (২১)।
রায়ের পর আসামিদের প্রতিক্রিয়া
রায়ের পর পরই কাঠগড়ায় দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রিফাত ফরাজীসহ সবাই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। একে-অপরকে জড়িয়ে সবাই চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তখন কাঠগড়ার বাইরে নির্বাক, নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিন্নি।
অপরদিকে কাঠগড়ায় থাকা খালাসপ্রাপ্ত রাফিউল ইসলাম রাব্বি ও মো. সাগর একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে মোনাজাত করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। আর কামরুল হাসান সাইমুন খালাসের রায় শুনে আনন্দে সবার সঙ্গে কোলাকুলি করেন। খালাসপ্রাপ্তদের মধ্যে মো. মুসা পলাতক রয়েছেন।
রায় ঘোষণা করে বিচারক এজলাস থেকে নেমে পড়েন। এর ১০ মিনিট পরে মিন্নিকে বিচারকক্ষ থেকে নিয়ে আদালতের গারদে নিয়ে রাখা হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে আসামিদের নেওয়া হয়।
এ সময় আসামি রিফাত ফরাজী আদালত চত্বরে থাকা স্বজনদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘কিছু হবে না, চিন্তা করো না…।’
পরে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে আসামিদের মধ্যে প্রথমে মিন্নিকে কঠোর নিরাপত্তায় একটি কালো মাইক্রোবাসে করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এর কিছুক্ষণ পর অপর সব আসামিকে প্রিজনভ্যানে করে একে একে কারাগারের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় আসামিদের স্বজনরা নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকেন।
গত বছরের ২৬ জুন প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রিফাতকে। মামলার ২৪ আসামির মধ্যে নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির রায় আজ ঘোষণা করেন বগুনার জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান। যদিও মামলার প্রধান আসামি মো. সাব্বির আহম্মেদ নয়ন ওরফে নয়নবন্ড পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
এ মামলায় মোট ৭৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন বরগুনার সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ভুবন চন্দ্র হালদার। সঙ্গে ছিলেন প্যানেলভুক্ত আইনজীবী এ এম মুজিবুল হক কিসলু ও মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল। আসামিদের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মাহবুবুল বারী আসলাম, মো. শাহজাহান মিয়া, হুমায়ুন কবীর, অলি উল্ল্যাহ সবুজ ও আবদুর রহমান নান্টু।