সরকারের ত্রাণের তালিকা প্রণয়নে দলীয়করণের অভিযোগ রিজভীর
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকারের ত্রাণের তালিকা প্রণয়নে দলীয়করণের অভিযোগ তুলেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি আরো বলেন, ‘সারা দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব যেভাবে বাড়ছে, তার বিপরীতে সরকারের প্রস্তুতি খুবই কম।’ রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আজ সোমবার দুপুরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন রিজভী।
রুহুল কবির রিজভী আরো বলেন, ‘রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা বেছে বেছে নিজস্ব লোকজনের মধ্যে চাল বিতরণ করছেন বলে গণমাধ্যমেও খবর বেড়িয়েছে। অন্যদিকে, গরিব মানুষের মধ্যে ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। ত্রাণের চাল চুরি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর সতর্কবার্তা থাকলেও থেমে নেই অপকর্ম। প্রাত্যহিক সংবাদপত্রে আওয়ামী লীগের স্থানীয় অনেক নেতাদের বিরুদ্ধে ত্রাণের চাল চুরি ও লুটপাটের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। কারো কারো গুদামে অভিযান চালিয়ে বিক্রয় নিষিদ্ধ ভিজিডির চাল, ত্রাণের চাল উদ্ধার করা হচ্ছে। এতদিন হয়েছিল সরাসরি টাকা লোপাট, এখন হচ্ছে রিলিফ লোপাট।’
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চলমান সংকটে সরকার ঘোষিত ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজে দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু বরাদ্দ আছে কি না—এমন প্রশ্ন রেখে রিজভী বলেন, ‘ক্ষুধা লকডাউন বোঝে না, কোয়ারেন্টিন বোঝে না, বোঝে না সামাজিক বা শারীরিক দূরত্বও।’
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব আরো বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দিনমজুর শ্রেণির জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে লকডাউন করা হয়েছে। আর আমাদের দেশে প্রণোদনা প্যাকেজেও এই মানুষগুলোর জন্য কিছু নেই। এরা তাহলে কী করবে, কোথায় যাবে? এ ছাড়াও বিভিন্ন সেবামূলক কাজে যারা জড়িত, তাদের নিরাপত্তা ও ঝুঁকি ভাতার কথা কোথাও নেই। বিশেষ করে এতদিন ধরে গণমাধ্যমকে সহায়তার যে কথা বলা হয়েছিল, তাও প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজে উল্লেখ নেই। অথচ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা এখন দায়িত্বপালন করছেন।’
রিজভী বলেন, ‘করোনাভাইরাসে বিধ্বস্ত বিশ্ব থেকে যতটা না সুসংবাদ আসছে, তার চেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে দুঃসংবাদ। একটি দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কমছে, তো বাড়ছে অন্য কয়েকটি দেশে। ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা শেষ পর্যন্ত বাড়ছেই। প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা অতিক্রম করছে লাখের ওপর। যে মুহূর্তে আপনাদের সামনে কথা বলছি, তখন গোটা বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ লাখের কাছাকাছি। মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছেন ৭০ হাজার মানুষ। আমাদের দেশে গত দুদিন ধরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। যা ভীতিকর পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা বিশ্ব এক অকল্পনীয় কঠিন সংকটের মুখোমুখি। আমরা আমাদের জীবদ্দশায়, এমনকি বিশ্বের হাতেগোনা সৌভাগ্যবান শতায়ু মানুষেরাও তাদের জীবদ্দশায় আর কখনোই এমন ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি হননি।’
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব আরো বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিকে তুলনা করা হচ্ছে বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও ভয়ংকর হিসেবে। এমন ঘোরতর সংকটেও বাংলাদেশ সরকারের হেঁয়ালি দেশের জনগণকে অসহায় করে তুলেছে। সরকার বিষয়টি নিয়ে জনগণের সঙ্গে কেন এতো লুকোচুরি করছে, এটি বোধগম্য নয়। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, উন্নত কিংবা অনুন্নত দেশ যারাই করোনাভাইরাস পরিস্থিতিকে গুরুত্ব না দিয়ে কথার ফুলঝুড়ি ছড়িয়েছে, তাদের এখন ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, এখানেই আমাদের ভয়। দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীরা প্রতিদিন যেভাবে তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অযথা বাক্যবাণ নিক্ষেপ কিংবা পরিস্থিতি সম্পর্কে স্ববিরোধী বক্তব্য-মন্তব্য করছেন, তাতে মনে হয়, সরকার এখনো পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলদ্ধি করতে পারছে না। এখানে সেখানে মানুষের মরদেহ পড়ে থাকার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। এটি শুভ লক্ষণ নয়।’
সাবেক এ ছাত্রনেতা বলেন, ‘দল হিসেবে আমরা শুরু থেকেই বলেছি, এই সংকটটি আমরা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করতে চাই না। কারণ, এই মরণঘাতী করোনাভাইরাস বেছে বেছে মানুষকেই টার্গেট করছে না, কিংবা করবে না। বরং একাধারে চলমান এই বৈশ্বিক ও জাতীয় সংকট বাংলাদেশে তো বটেই, সারা বিশ্বে এখন খোদ মানবজাতির অস্তিত্বের সংকট। এ কারণে আপনারা দেখেছেন, শুনেছেন, আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত ২৪ মার্চ তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন, ‘দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের কাছে অবশ্যই বর্তমান সরকারের বৈধতার সংকট রয়েছে, কিন্তু চলমান করোনাভাইরাস সংকট অত্যন্ত ভয়াবহ এবং বিপর্যয়কর। বর্তমান সংকট মানুষের বাঁচা-মরার সঙ্গে জড়িত। তাই এই সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিএনপি সরকারকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে প্রস্তুত। কারণ, বিএনপি বিশ্বাস করে, দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্যই রাজনীতি।’
রিজভী বলেন, ‘বর্তমান সংকটে আমরা আমাদের অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরার পরও আপনারা দেখছেন, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কিংবা হাছান মাহমুদ কারণে-অকারণে বিএনপির বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কথা বলা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন। এ কারণে আওয়ামী লীগের কথার জবাব দিয়ে বিএনপি সময় নষ্ট করতে চায় না। আমরা বরং সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলতে চাই, যেহেতু রাষ্ট্রীয় অর্থ, রাষ্ট্রীয় যন্ত্র আপনাদের হাতে, সেহেতু এই মুহূর্তে দেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানো আপনাদের দায়িত্ব।’
বিএনপির এই নেতা আরো বলেন, ‘দেশের হাজার হাজার গার্মেন্টস শ্রমিকদের সঙ্গে সরকার যে আচরণটি করেছে, এটি কোনো সভ্য রাষ্ট্র কিংবা সভ্য সরকারের আচরণ হতে পারে না। শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অবস্থানগত পার্থক্য, সর্বোপরি সমন্বয়হীনতা সংশ্লিষ্ট সবাইকে মর্মাহত করেছে। সরকারের পাশাপাশি এই খাতের উদ্যোক্তাদের নেতৃত্বও চরম দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে। কারখানা খোলা ও বন্ধ রাখা নিয়ে লুকোচুরি খেলা খুবই ন্যাক্কারজনক। চাকরি হারানোর ভয়ের কাছে মৃত্যুভয়কেও হার মানিয়েছে পোশাক শ্রমিকসহ নিম্ন আয়ের মানুষজনকে। ফলে এরা সরকারের বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে রাস্তায় নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরতে শুরু করে কর্মস্থলে। গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় হাজার হাজার শ্রমিক ট্রাকে, কেউবা হেঁটে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার কর্মস্থলে গেলেন। যে পরিমাণে জনসমাগম হলো, তা সত্যিই আতঙ্কের। আমাদের মনে ভয় জাগছে।’