সাফারি পার্কে প্রাণীর মৃত্যুতে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত
গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে ১১টি জেব্রাসহ প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়। প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য করা হবে বিভাগীয় মামলা। এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে তদন্ত কমিটির ২৪টি সুপারিশ।
সাফারি পার্কের প্রাণীর মৃত্যুরোধ এবং ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য করণীয় বিষয়ে তদন্ত কমিটি ১১টি স্বল্পমেয়াদি, চারটি মধ্যমেয়াদি এবং নয়টি দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ করেছে।
গতকাল মঙ্গলবার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা সভায় এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
গত জানুয়ারি মাসে ২৭ দিনের ব্যবধানে ১১টি জেব্রা মৃত্যু হয়। এ সময়ে একটি সিংহী এবং একটি বাঘের মৃত্যু হয়।
নয়টি জেব্রার মৃত্যুর পর সাফারি পার্ক প্রকল্পের পরিচালক মো. জাহিদুল কবির বলেছিলেন, হঠাৎ তারা দল থেকে আলাদা হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। পেট ফুলে গিয়ে মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে। এক সময় মারা যায়।
‘জেব্রা দলবেঁধে চলে। মৃত্যুর আগে এদের মধ্যে কোনো রোগের উপসর্গ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না’ উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞদলের প্রথম বৈঠকের আগে প্রকল্প পরিচালক বলেছিলেন, ‘খাদ্যে বিষক্রিয়া, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণসহ নানা কারণে জেব্রাগুলোর মৃত্যু হতে পারে।’
সে সময় করোনা সন্দেহে প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল বলেছিলেন, ‘পিসিআর ল্যাবে মৃত জেব্রাগুলোর নমুনা পাঠিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। এ ছাড়া মৃত জেব্রাগুলোর ফুসফুস, লিভার, মৃত্যুর পর পেটে থাকা অর্ধগলিত খাবার পরীক্ষা করা হয়েছে।’
প্রকল্প পরিচালকের নির্দেশে গঠিত ছয় সদস্যের বিশেষজ্ঞ বোর্ড সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, অতিরিক্ত কাঁচা ঘাস ছাড়াও স্ট্রেপ্টোকক্কাস, ই-কোলাই, ক্লস্টোডিয়াম, সালমোনিলা ও পাস্টুরেলা নামে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে পাঁচটি এবং নিজেদের মধ্যে মারামারি করে আরও চারটি জেব্রা মারা যায়—জানান সাফারি পার্ক প্রকল্প পরিচালক।
এ ঘটনায় ২৬ জানুয়ারি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার ভৌমিককে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে আট জনের আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে প্রাণী মৃত্যুর ঘটনায় রুল জারি করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারির পাশাপশি বন ও পরিবেশ সচিবকে অবিলম্বে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের নির্দেশ দেন। রুলে ১১টি জেব্রা ও একটি বাঘের মৃত্যুর ঘটনায় কর্তৃপক্ষের অবহেলা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং সাফারি পার্কের বন্যপ্রাণীদের রক্ষায় দ্রুত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।
এরপর গতকাল মঙ্গলবার সাফারি পার্কে প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনায় দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়।
তদন্ত কমিটির মতামতে বলা হয়, ঘাসে অতিরিক্ত নাইট্রেটের প্রভাব ও মিশ্র ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে ১১ জেব্রার মৃত্যু ঘটেছে বলে তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে, প্রথম দিকের তিনটি জেব্রার মৃত্যু ধামাচাপা দেওয়া এবং আঘাতজনিত কারণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য মৃত তিনটি জেব্রার পেট ধারাল কিছু দিয়ে কাটা হয়েছে। কে বা কারা মৃত তিন জেব্রার পেট কেটেছে, তা উদঘাটনের জন্য নিবিড় তদন্তের প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, কর্তব্যরত ভেটেরিনারি কর্মকর্তার চাহিদা মোতাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সাফারি পার্ক মেডিকেল বোর্ডের সভা আহ্বান করার বিধান থাকা সত্ত্বেও এতগুলো জেব্রার অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরও জরুরিভিত্তিতে মেডিকেল বোর্ডের সভা আহ্বান করা হয়নি। যা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার শামিল। কোনো প্রাণীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় জিডি করার প্রচলন থাকলেও এক্ষেত্রে থানায় কোনো জিডি করা হয়নি, যা রহস্যজনক।
গতকাল সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপ-মন্ত্রী হাবিবুন নাহার, সচিব মো. মোস্তফা কামাল, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন, অতিরিক্ত সচিব (জলবায়ু পরিবর্তন) মো. মিজানুল হক চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) ও তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক সঞ্জয় কুমার ভৌমিক, অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ) কেয়া খান এবং উপসচিব ও তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াদুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।