সেই বাড়িওয়ালি নিয়মিত ভাড়াটিয়াদের থেকে ভাত চেয়ে খেতেন!
রাজধানীর কলাবাগানের একটি বাসার মালিক নূর আক্তার শম্পা। তিনি গত শনিবার সকালে তার বাসার নিচতলার ভাড়াটিয়া কুলসুমকে ভাত-তরকারি রান্না করে দিতে বলেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে কুলসুমসহ তার পরিবার ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। ফলে বাসায় বেশি কিছু না থাকায় দুপুরে শুধু আধা কেজি চালের ভাত রান্না করে দিয়ে আসেন শম্পাকে।
পরে রাত ৮টার দিকে নূর আক্তার শম্পা ভাড়াটিয়া কুলসুমের কক্ষে যান। গিয়ে তিনি কুলসুমকে বলেন, ‘ভাত-তরকারিও ঠিকমতো দিতে পারিস না। তাহলে এখন বাকি থাকা এক মাসের ভাড়া দিবি। না দিতে পারলে এখনি বাসা থেকে বের হয়ে যাবি।’
তখন কুলসুম বাড়িওয়ালিকে বলেন, ‘এখন কোনোভাবেই ভাড়া দিতে পারব না আপা। অনেকেই ত্রাণ দিচ্ছে, তাই দিয়ে সংসার চালাচ্ছি। বাসায় তরকারি ছিল না বলে আপনাকে শুধু ভাত দিয়েছি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। এই রাতে আমার দুই মাসের ছেলেকে নিয়ে আমরা কোথায় যাব? আমরা গরিব বলে আমাদের তাড়িয়ে দিবেন না।’
এই কথা শুনে কুলসুমকে তখন নূর আক্তার শম্পা বলেন, ‘দাঁড়া তোদের বাপকে নিয়ে আসছি। দেখি কীভাবে বাসায় থাকিস।’ এরপর শম্পা ৯৯৯ এ ফোন করে বলেন, ‘আমার বাসার ভাড়াটিয়া আমার বাড়ি ভাঙচুর করছে। আমাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। আপনারা আমাকে রক্ষা করেন।’
এরপর ৯৯৯ থেকে কলাবাগান থানা পুলিশকে বিষয়টি জানান। পরে কলাবাগান থানার উপপরিদর্শক সাইদুর রহমান ওই বাসায় যান।
গিয়ে কী দেখেছিলেন তার বর্ণনা দিয়ে সাইদুর বলেন, ‘৯৯৯ থেকে ফোন করে আমাদের বলা হলো, ভাড়াটিয়া বাড়ির মালিককে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে বাড়ি ভাঙচুর করছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখলাম, বাড়িওয়ালি ভাড়াটিয়া কুলসুমের সঙ্গে ঝগড়া করছেন ভাড়া নিয়ে। আর ভাড়ি ভাঙচুর কিংবা হত্যার হুমকির কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। বাড়িওয়ালি সব মিথ্যা কথা বলেছেন। এরপর আমি বাড়িওয়ালিকে বললাম, এত রাতে তারা কোথায় যাবেন? রাতটা থাকতে দেন, যা করবেন দিনের বেলা করবেন। তখন শম্পা আমাকে বলেছিলেন, আচ্ছা, দেখছি কী করা যায়। আমরা চলে আসার পর ওই বাড়িওয়ালি গেট লাগিয়ে তাদের বের করে দেন। এরপর ওই রাতে কুলসুমসহ তার পরিবার নিয়ে বাড্ডার ভাইয়ের বাসায় চলে যান।’
আজ বুধবার দুপুরে র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়নে (র্যাব-২) কোম্পানি কমান্ডার (সিপিসি-২) মেজর এইচ এম পারভেজ আরেফিন, কলাবাগান থানার পরিদর্শক (এসআই) সাইদুর রহমান এবং ভাড়াটিয়া কুলসুম এনটিভি অনলাইনকে এসব ঘটনা জানান।
শনিবার রাতেই ওই ঘটনা র্যাবের নজরে আসে। তখন র্যাব থেকে কলাবাগান থানায় যোগযোগ করে পরের দিন অর্থাৎ রোববার বেলা ১১টার দিকে র্যাব ঘটনাস্থলে যায়। সঙ্গে পুলিশও ছিল। কিন্তু র্যাব গিয়ে বাড়িওয়ালিকে বাসায় পাননি। পরে কোম্পানি কমান্ডার মেজর এইচ এম পারভেজ আরেফিন শম্পাকে ফোন করেন।
সে সময়য়ের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পারভেজ আরেফিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ফোন করার পর শম্পা আমাকে বলেন, আপনারা আইনের লোক বলে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। আমার সঙ্গে অন্যায় করছেন। আমি এখন আমার ভাইয়ের বাসায় আছি। সেখান থেকে আসা সম্ভব না। আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। একপর্যায়ে শম্পা আমাকে আরো বললেন, আপনারা থাকেন আমি বের হয়েছি, আসতেছি। এরপর তিনি আর এলেন না। অথচ তার জন্য আমরা রাত ৮টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম। তার বাসায়ও ঢুকতে পারিনি। কারণ তিনি তালা মেরে চলে গেছেন। ওই বাসায় যে ভাড়াটিয়ারা ছিলেন তারাও বের হতে পারছিলেন না। কারণ, কারো কাছেই চাবি ছিল না। তারা প্রয়োজনীয় কাজও মেটাতে পারছিলেন না।’
এইচ এম পারভেজ আরেফিন বলেন, ‘মজার বিষয় হচ্ছে, উনার বাসার সামনে সারা দিন থেকে যেটা শুনেছি, স্থানীয় অনেকের সঙ্গে উনার দ্বন্দ্ব আছে। সাবেক ভাড়াটিয়ারাও ওই নারীর কাছে টাকা পান। এ ছাড়া কয়েকজন অভিযোগ করেছেন, বাড়িওয়ালি নাকি ভাত রান্না করতেন না। ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে ভাত-তরকারি চেয়ে চেয়ে খেতেন। এই ঘটনার সূত্রপাতও কিন্তু ভাত-তরকারি চাওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়। পরে বিষযটি গড়ায় বকেয়া থাকা ভাড়ার দিকে। যাই হোক, একটি সময় আমরা না পেরে সেখান থেকে চলে আসি। এই সময়ের ভেতর দফায় দফায় ওই বাড়িওয়ালির সঙ্গে কথা হয় আমার। সে সময় তিনি আমাকে নানা ধরনের বাজে কথা বলেন। অপমান করেন। বাড়িওয়ালি আমাকে বললেন, আমি তাদের (ভাড়াটিয়া) বের করে দেইনি,। পুলিশ সব ঘটনা জেনেবুঝে তাদের বের করে দিয়েছে।। আসলে সব তথ্যই মিথ্যা। যেটা খুবই বিব্রতকর।। আমরা চলে যাওয়ার পর কুলসুমের স্বামী মো. সেলিম কলাবাগান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।’
কোম্পানি কমান্ডার আরো বলেন, ‘পরের দিন অর্থাৎ সোমবার কলাবাগান থানা পুলিশ ওই বাসায় গিয়ে কুলসুমসহ তার পরিবারকে বাসায় উঠিয়ে দিয়ে আসে। এরপর থেকে আমরা নূর আক্তার শম্পার ফোন ট্র্যাকিং শুরু করি। তিনি একেক সময় একেক স্থানে অবস্থান করতেন বলে আমরা জানতে পারছিলাম।। কখনো তার নম্বর বন্ধ দেখাত।। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে তাকে আমরা ধানমণ্ডি থেকে গ্রেপ্তার করি।’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ভাড়াটিয়া কুলসুম বলেন, ‘ঘটনার শুরু হয় ভাত চাওয়াকে কেন্দ্র করে।। শনিবার আমাকে শম্পা আপা ভাত দিতে বললে আমি ৫০০ গ্রাম চালের ভাত রান্না করে দেই।। কিন্তু ঘরে কিছু না থাকায় তরকারি দিতে পারিনি। পরে তরকারি কেন দিলাম না, তাই নিয়ে ঝগড়া শুরু করেন।। একটা সময় বাকি থাকা এক মাসের ভাড়া দিতে বলেন।। যখন আমি বললাম, এখন ভাড়া দিতে পারব না।। আমার কাছে কোনো টাকা নেই।। তারপর নানা কাহিনি করে আমাদের বের করে দেন।। সাততলার এই বাসায় মোট ১৮টি ফ্ল্যাট আছে।। সব ফ্ল্যাট থেকেই শম্পা আপা ভাত চেয়ে চেয়ে খেতেন। এটা নিয়ে সব ভাড়াটিয়ার অভিযোগ আছে।। একেকদিন একেজনের কাছ থেকে ভাত চেয়ে খেতেন।। এ ছাড়া তিনি বসুন্ধরার সিটির বড় বড় দোকানদারকে সুদে টাকা দেন।। প্রায়ই বসুন্ধরায় গিয়ে তিনি যাদের সুদে টাকা দিয়েছেন তাদের কাছ থেকে বিরিয়ানি নিয়ে আসতেন।। আমি প্রায়ই এসব দেখেছি।। শম্পা আপাও বলতেন। করোনার কারণে এখন প্রায় সব ভাড়াটিয়া চলে গেছেন।। তাই আমার কাছে প্রায় প্রায়ই ভাত চান।। খুব প্রয়োজন না হলে তিনি রান্না করেন না।’
কুলসুম আরো বলেন, ‘আজ বুধবার সকালে শম্পা আপার বাবা-মা ও ভাই এসে আমাকে বললেন, মামলা তুলে নিতে।। আমি বলে দিয়েছি, এটা আমার হাতে নেই।। আমার দ্বারা সম্ভব না।। কারণ, স্যারেরা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।, আমি কাউকে কিছু বলতে পারব না। তখন উনারা আমাকে কথার মাধ্যমে হুমকি দেওয়ার চেষ্টা করলেন।। লোকজন দিয়ে শম্পাকে ছাড়িয়ে নিবেন বলেও জানালেন।’