সড়ক আইন বেহাত হলে কান্না কখনো থামবে না : ইলিয়াস কাঞ্চন

নতুন সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর বাস্তবায়ন নিয়ে বাংলাদেশে আলোচনা এখন তুঙ্গে। কঠোর শাস্তির বিধান রেখে তৈরি করা এই আইনটি বাংলাদেশে দুর্ঘটনা রোধে ‘মাইলফলক’ হিসেবে কাজ করবে বলে ধারণা করা হলেও পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা এর তীব্র বিরোধিতা করছে।
তারা সারা দেশে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকরা এই আইনটি তৈরির পেছনে ভূমিকা রাখার জন্য চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে ‘দায়ী’ করে তাঁর বিচারও দাবি করেছে। বিভিন্ন স্থানেই ঢাকাই চলচ্চিত্রের এই নায়কের ছবি ও ব্যানারও টানিয়ে সড়ক অবরোধ করেছে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা।
বাংলাদেশের এক সময়ের জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’-এর প্রধান। ১৯৯৩ সালে মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রিয়তম স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনকে হারানোর পর থেকেই দুর্ঘটনামুক্ত ও নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করতে দেশের একপ্রাপ্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে বেরিয়েছেন। এর পরই বাংলাদেশের সড়কে ফোরলেন, সড়কে ডিভাইডার তৈরি, মহাসড়ক থেকে নসিমন-করিমন উঠিয়ে নেওয়া, প্রতিবছর নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা- এমন সাফল্য এসেছে।
ঠিক তেমনি সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের তোপের মুখেও পড়তে হয়েছে এই ‘নিসঙ্গ শেরপা’কে। কিন্তু সময়ে-অসময়ে কখনোই নিজেকে রাজপথ থেকে উঠিয়ে নেয়নি। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে চেষ্টা করেছেন একটি যুগপোযুগী ও সবার স্বার্থরক্ষাকারী আধুনিক আইন প্রণয়নের জন্য জনমত গড়ে তুলতে। আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে টানা আন্দোলনের পর কাঙ্ক্ষিত সেই পরিবহন আইন এখন সড়কে।
যদিও শ্রমিকরা দাবি করেছে, এতে দুর্ঘটনার জন্য তাদের যে পরিমাণ শাস্তি ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে, তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। ‘ফাঁসির দড়ি গলায় নিয়ে’ কোনো শ্রমিক গাড়ি চালাবে না। তারা আইনটি স্থগিত করার জন্য আন্দোলন, দেন-দরবার করছে। বিক্ষোভের সময় চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিতে প্রহার করা, অগ্নিসংযোগও করছে শ্রমিকরা।
শ্রমিকদের এই প্রতিক্রিয়ায় কী বলছেন ঢাকা চলচ্চিত্রের এই নায়ক? নতুন সড়ক আইন নিয়েই বা তাঁর বক্তব্য কী- এসব বিষয় নিয়েই খোলামেলা কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে।
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘নতুন আইনটি র্কাযকর হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে আমাকে হেনস্তা করার চেষ্টা করছে। এমনটা অতীতেও হয়েছে। আমরা দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করেছি। ভালো কিছু অর্জন করতে হলে কিছু ভোগান্তি সহ্য করতেই হবে। তবে আমি বিশ্বাস করি, আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাবই।’
নতুন আইনটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাঁরা ধীরে হাঁটছেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই আইন কাউকে শাস্তি দেওয়ার জন্য নয়। বরং সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই এর উদ্দেশ্য। ধর্মঘট ডেকে অযথাই মানুষকে ভোগান্তিতে না ফেলার আহ্বানও জানিয়েছেন তাঁরা। আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে এ সংক্রান্ত ভ্রাম্যমাণ আদালতেও এ ব্যাপারে ছাড় দিচ্ছে। কঠোর জরিমানার পরিবর্তে ‘টোকেন’ জরিমানা করে পরিবহন চালক ও শ্রমিকদের সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে আলাপেও ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’-এর প্রধানের কণ্ঠেও সেই বিষয়টিই উঠে এসেছে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এখন যে আইনটি হয়েছে তা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য, কাউকে জেলে পাঠানো বা জরিমানা আদায় করার জন্য নয়। সবাই যদি নিয়ম মেনে চলে, ভয় কীসের।’
‘আমি মনে করি, কোনো মহলের চাপে আইনটি বেহাত হলে দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ সম্ভব নয়। কোনোদিনই থামবে না অসহায় পরিবারের কান্না।’
আন্দোলনকারী পরিবহন শ্রমিকদের প্রতি ইলিয়াস কাঞ্চনের সতর্কবার্তা, ‘আইনটি বাতিলের জন্য যাঁরা আজ আন্দোলন করছেন, একসময় দুর্ঘটনা তাঁদেরও হতে পারে। তখন তাদের পরিবারের কান্না দেখার কেউ থাকবে না।’
সড়কে যে বিশৃঙ্খলা তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ইলিয়াস কাঞ্চন আইন পরিবর্তনের পাশাপাশি নিজেদের মন-মানসিকতা পরিবর্তনের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি সবাইকে বলব, আপনি অপরাধ করলে আপনার জরিমানা হবে, শাস্তি হবে। অপরাধ না করলে কিছুই হবে না, সড়কে শান্তি ফিরবে।’

ইলিয়াস কাঞ্চন প্রশ্ন তুলেন, ‘আপনারা (পরিবহন শ্রমিক) নিজেদের সংশোধন না করে কেন আইন সংশোধন করতে চাইছেন? লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি, অদক্ষ ড্রাইভার, ফিটনেস ছাড়া গাড়ির পক্ষে কেউ আন্দোলন করতে পারে?’
আইন সংশোধনের দাবিতে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় হঠাৎ করেই কয়েকদিন আগে বাস বন্ধ করে দেওয়ায় যাত্রীরা ভোগান্তির শিকার হয়। একপর্যায়ে বাসের পাশাপাশি ট্রাক, কাভার্ডভ্যান শ্রমিকরাও ধর্মঘটে সামিল হন। তাতে যাত্রীদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের ভোগান্তিও চরমে পৌঁছে। সবশেষ নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনসহ নয় দফা দাবি আর ধর্মঘট নিয়ে স্বারষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা। প্রথম দিনের বৈঠক থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় গতকাল বুধবার রাতে আবার বৈঠক হয়। চার ঘণ্টার লাগাতার বৈঠক শেষে সরকারের আশ্বাসে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন শ্রমিক নেতারা। এরপর আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো।
ইলিয়াস কাঞ্চন মনে করেন, শ্রমিকদের অনেকেই না বুঝে আন্দোলন করছেন, জনসাধারণের ভোগান্তি তৈরি করছেন। তিনি শ্রমিকদের আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানান। অপরদিকে যাত্রীদেরও সড়কে আইন মেনে চলার পরামর্শ দেন। যাত্রীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যাঁরা ভোগান্তির শিকার, তাঁদের বলব- এই ভোগান্তি সাময়িক, ভালো কিছু পাওয়ার জন্য একটু কষ্ট করতে হয়।’
স্ত্রী জাহানার কাঞ্চন যখন সড়ক দুর্ঘটনায় কবলে পড়েন তখন ইলিয়াস কাঞ্চন বান্দরবানে একটি ছবির শুটিংয়ে ছিলেন। জাহানারা দুই সন্তানকে নিয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে করে বান্দরবানে যাচ্ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চনের কাছে। স্ত্রী-সন্তানরা আসছেন শুনে ইলিয়াস ছিলেন ছিলেন খুবই উৎফুল্ল। আর সেদিন, ১৭ অক্টোবর বান্দরবানের আকাশেও ছিল অনেক রোদ। এর কিছুক্ষণ পরই মেঘ এসে সেই সূর্যকে ঢেকে দেয়। চিত্রনায়কের জীবনে নেমে আসে মেঘের ঘনঘটা। খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখেন সাদা কাপড়ে ঢাকা প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখ, তার পাশে বসে কাঁদছে দুটি অবুঝ শিশু।
সেই করুণ স্মৃতি আজো তাড়িয়ে বেড়ায় বাংলা চলচ্চিত্রের এই জনপ্রিয় নায়ককে। তবু তিনি জীবনকে সামনের দিকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে। বলেন, ‘আশা করি, একসময় বাংলাদেশের রাস্তা হবে নিরাপদ, যাঁরা নিজের সন্তানকে চুমু খেয়ে বাসা থেকে বের হয়েছেন, তাঁরা কাজ শেষে আবারও বাসায় গিয়ে সেই সন্তানকে জড়িয়ে ধরতে পারেন। আপনার লাশ ধরে অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে কাঁদতে হবে না আপনার সন্তানকে।’