ডুমুরিয়ায় ভূমিহীনদের উচ্ছেদে তাণ্ডব

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা সদরে ১০ ভূমিহীন পরিবারের ঘরবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে প্রভাবশালীরা। লুটপাট করেছে ঘরের মালামাল ও টাকা। বুধবার সকালে ডুমুরিয়া থানা থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে এই তাণ্ডব চলে তিন ঘণ্টাব্যাপী। কিন্তু পুলিশ এগিয়ে আসেনি। হামলার পর থেকে অসহায় ভূমিহীন পরিবারগুলো খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রফিকুল হাসান বলেন, ‘ভূমিহীন পরিবারের ওপর যে হামলা হয়েছে, তা অত্যন্ত অমানবিক। ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন পরিবারকে সহায়তা দিতে জেলা প্রশাসক নির্দেশ দিয়েছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা হিসেবে প্রাথমিকভাবে ঢেউটিন ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।’
এদিকে, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ডুমুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য শাহিনুজ্জামান সরদারকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ডুমুরিয়া উপজেলা সদরের ট্রলারঘাটের আশপাশসহ ভদ্রা নদীর ভরাট অংশে তিন শতাধিক পরিবার বসবাস করে। এর মধ্যে ট্রলারঘাটের কাছে এবং থানা থেকে ২০০ গজ দূরে ১০টি পরিবারের প্রায় ১৫টি বসতঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। বুধবার সকাল ৭টার দিকে শিমুল বিশ্বাস, ইউপি সদস্য শাহিনুজ্জামান সরদার ও হাবিবুর রহমান বিশ্বাস ওরফে বোমা হাবিব ৪০/৫০ জন লোক নিয়ে ওই হামলা চালায়। তাদের হাতে ছিল রড, কাটা পাইপ, রামদা, হাতুড়ি, কুড়াল, লাঠিসোটা। এ সময়ে তারা ব্যাপক লুটপাট ও ভাঙচুর চালায়।
১০টি ভূমিহীন পরিবারে নারী-শিশুসহ প্রায় ৪০ জন বসবাস করে। হামলা-ভাঙচুরের সময়ে নারী-পুরুষসহ ১০-১৫ জন আহত হন। সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা ধরে সেখানে হামলাকারীরা তাণ্ডব চালায়। ঘটনার সময়ে সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যরা দাঁড়িয়ে থাকলেও ভূমিহীনদের সহযোগিতা করতে তারা এগিয়ে আসেনি।
হামলাকারীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন দারোগা
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ভূমিহীনদের ওপর তাণ্ডব চালানোর ঘণ্টা দুয়েক পর বাজারের কসাইখানার টিউবওয়েলের পাশে দাঁড়িয়ে থানার দারোগা নজরুল ইসলাম হামলাকারী শিমুল বিশ্বাস, শাহিন সরদার, হাবিবুর বিশ্বাস ওরফে বোমা হাবিব, বকুল বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলছিলেন। দারোগা নজরুল এ সময়ে সাদা পোশাকে একটি কালো রঙের মোটরসাইকেলে চড়ে আসেন। পরে তিনি রউফ হালদারের মিলের সামনের রাস্তা দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে চলে যান।
লিডারের নির্দেশ
হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত সলিম হাওলাদারের স্ত্রী শাবানা বেগম বলেন, ‘আমার শিশুসন্তান সকালে রান্নাঘরে খেতে বসেছিল। হঠাৎ করে হাবিসহ আরো চার-পাঁচজন লোক আমার রান্নাঘরে ঢুকে ছেলের সামনে ভাতের থালা লাথি মেরে ফেলে দেয়। আমার চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ঘরের বাইরে বের করে দেয়। এমন কেন করা হচ্ছে জানতে চাইলে হাবি বলে, লিডারের নির্দেশ, জায়গা খালি করতে হবে। ঘর ছেড়ে চলে যা, না হলে গুলি করে মারব।’
ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী আবদুল হান্নান শেখ (৬৭) বলেন, ‘২০ বছর আগে জমিতে দখলে থাকা ও জনৈক ইসহাক খানের কাছ থেকে আমি এই জমিটুকু কিনি। সে সময় থেকে এখানে ঘর বেঁধে বসবাস করছি। দুই-তিন মাস আগে এলাকার মজিদ বিশ্বাসের ছেলে শিমুল বিশ্বাস আমিসহ এখানে বসবাসকারী অন্যান্য ভূমিহীন পরিবারকে জায়গা ছেড়ে দিতে হুমকি-ধমকি দেয়। বুধবার সকালে শিমুল ও হাবি তাঁদের দলবল নিয়ে আমাদের ওপর হামলে পড়ে। আমি সে সময়ে ভাত খেয়ে কাজে বের হচ্ছিলাম। আমাকে তারা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এবং কাঠের চলা দিয়ে আমার পিঠে আঘাত করতে থাকে। আমি চিৎকার করলেও তারা কাউকে এগিয়ে আসতে দেয়নি।’
হান্নান জানান, এই জমি সরকারি খাসজমি। ভূমিহীন হিসেবে জমি বরাদ্দ পেতে তিনি আবেদন করেছেন।
আরেক ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ব্যবসায়ী এবাদুলের স্ত্রী জলি বেগম (৩৫) বলেন, ‘সকালে আড়তে মাছ কিনতে যাওয়ার জন্য আমার স্বামী গোছগাছ করছিল। এমন সময়ে একদল যুবক আমার ঘরে প্রবেশ করে আমাকে টানতে টানতে ঘর থেকে বের করে আনে। তারা আমার স্বামীকে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি মারতে থাকে। তারা ঘরে বাক্সে রাখা ৪০ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে গেছে। মঙ্গলবার মাছ বিক্রি করে ঘরে ওই টাকা রেখেছিলাম।’
ডুমুরিয়া থানার ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ
জলি বেগম বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে শিমুল বিশ্বাস থানায় মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে থানায় ডেকে নিয়ে যায়। এ সময়ে থানার ওসি সাহেব আমাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। ওসি সাহেব জমি ছেড়ে দিতেও আমাদের শাসান।’
ক্ষতিগ্রস্ত আমিরুন্নেছা (৫৮) বলেন, ‘থানায় ডেকে ওসি সাহেব বলেন, জায়গা ছেড়ে দিবি না হলে সবগুলারে ধরে হাজতে ঢুকায়ে দেব। আজ যেভাবে আমাদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে তা একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও দেখিনি।’
মাসখানেক আগে থেকেই ভূমিহীন পরিবারদের উচ্ছেদের জন্য বারবার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল বলে জানিয়েছেন ভূমিহীন নেত্রী সাবেক ইউপি সদস্য জাহানারা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার বিষয়টি নিয়ে পুলিশকে জানিয়েছি। কিন্তু ওসি সাহেব ভূমিহীনদের জায়গা ছেড়ে দিতে হুমকি দেন। জায়গা ছেড়ে না দিলে সবাইকে হাজতে ঢুকিয়ে দেওয়ারও হুমকি দেন ওসি।’
খাসজমি কিনেছেন হামলাকারী?
সরকারি খাসজমির মালিকানা দাবি করে শিমুল বিশ্বাস বলেন, জনৈক ফারুকের কাছ থেকে তিনি ৫০ শতক জমি কিনেছেন। সেখানে ১০/১২টি পরিবার ভাড়াটে হিসেবে বসবাস করে। ওই জমিতে পাকা ঘর নির্মাণের জন্য ভাড়াটেদের ঘর ছেড়ে দিতে বললেও তারা ঘর ছাড়তে টালবাহানা করতে থাকে। বিষয়টি থানা পুলিশকে জানানো হয়েছে। একাধিকবার পুলিশ তাদের ঘর ছেড়ে দিতে বললেও তারা ঘর ছাড়েনি। তাই তাদের ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
হার মেনেছে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার
ডুমুরিয়া ইউপির সদস্য ও উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক তহমিনা বেগম বলেন, ‘ভূমিহীনদের ওপর আজ যে ঘটনা ঘটানো হলো তা পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারকেও হার মানিয়েছে।’ তিনি বলেন, বিষয়টি জেলা প্রশাসককে মোবাইল ফোনে জানানো হয়েছে। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
ওসি নিশ্চুপ
হামলা ও পুলিশের ভূমিকার ব্যাপারে বক্তব্য জানতে ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে তাণ্ডব শেষ হওয়ার দুই ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে আসা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) লিটন মল্লিক বলেন, ‘ওসি স্যার ছুটিতে আছেন।’
তাণ্ডব দেখে হতবাক এএসপি
ঘটনার পর বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে আসেন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) ফরহাদ খান। তিনি ঘটনার নৃশংসতা দেখে হতবাক হন। এ সময়ে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন পরিবারের সদস্যরা তাঁর কাছে ডুমুরিয়া থানা পুলিশের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এএসপি তাঁদের যার যার অবস্থানে বসবাস করার কথা বলেন এবং সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ভূমিহীন পরিবারকে জমি বরাদ্দ নিতে অনুরোধ জানান।
এএসপি ফরহাদ খান বলেন, ‘যদি কেউ জমির মালিক দাবিদার হন, তাহলে আদালতের মাধ্যমে এর নিষ্পত্তি হতে পারে। এভাবে কারো ওপর হামলা করা বেআইনি।’
হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে মন্ত্রীর নির্দেশ
হামলার ব্যাপারে স্থানীয় আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘যারা অসহায় ভূমিহীনদের ওপর হামলা চালিয়েছে, তারা যে দলের লোক হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে সব সুবিধা দেওয়া হবে।’
অবশেষে থানায় মামলা
এদিকে হামলার ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে নজরুল ইসলাম গাজী ডুমুরিয়া থানায় একটি মামলা করেছেন। এতে ১৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৩০/৪০ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ ইউপি সদস্য ও মামলার প্রধান আসামি শাহিনুজ্জামান সরদারকে গ্রেপ্তার করেছে।