সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলীর ইন্তেকাল
সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী আজ শনিবার দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটে খুলনার ফারাজীপাড়ায় নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি অয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি প্রস্টেট গ্যালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে খুলনায় নিজ বাসায় চিকিৎসাধীন ছিলেন।
তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তিনি স্ত্রী, পাঁচ মেয়েসহ বহু গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
শেখ রাজ্জাক আলীর স্ত্রী অধ্যক্ষ বেগম মাজেদা আলী এনটিভি অনলাইনকে জানান, আগামীকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানে শেখ রাজ্জাক আলীর প্রথম জানাজা হবে। দুপুরে পাইকগাছায় দ্বিতীয় জানাজার পর তাঁর লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।urgentPhoto
শেখ রাজ্জাক আলীর মৃত্যুর খবরে খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু, সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুজ্জামান মনি, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক সংসদ সদস্য এম নুরুল ইসলাম, বিএনপি নেতা সাহারুজ্জামান মোর্তজাসহ বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে শোক প্রকাশ করেন।
বিএনপি নেতা ও শেখ রাজ্জাক আলীর স্বজনদের সূত্রে জানা যায়, ১৯২৮ সালের ২৮ আগস্ট খুলনার পাইকগাছা উপজেলার হিতামপুর গ্রামে শেখ রাজ্জাক আলীর জন্ম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে (১৯৫২) ও বাংলা সাহিত্যে (১৯৫৪) স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার পর এলএলবি সম্পন্ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি সক্রিয়ভাবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে তিনি খুলনা জেলা জজ কোর্টে ওকালতি শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্ট বারের সদস্য হন ও ১৯৬৪ সালে খুলনা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি খুলনা ল কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন সহ-অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেন। এরপর তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর ওই কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
শেখ রাজ্জাক আলী সিটি ল কলেজ খুলনা, সুন্দরবন আদর্শ মহাবিদ্যালয় খুলনা, সবুরন্নেসা মহিলা কলেজ খুলনা, বয়রা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, টুটপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাইকগাছা ডিগ্রি কলেজ, শহীদ জিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় পাইকগাছা, বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল শিরোমণি খুলনা, সিটি ল কলেজ মসজিদ, হিতামপুর জামে মসজিদ এবং কপিলমুনি শাহ্ জাফর আউলিয়া মাজারসংলগ্ন মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। এ ছাড়া তিনি মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ খুলনা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ, খুলনা মহিলা আলিয়া মাদ্রাসা ও হাজি ফয়েজউদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বয়রার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বেসরকারি আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্ল্যাস্ট) প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি।
স্বজনরা জানান, ১৯৭১ সালে শেখ রাজ্জাক আলী মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সশস্ত্র অংশগ্রহণ করতে না পারলেও তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে টেট্রা ক্যাম্পে চলে যান এবং রেডক্রসে যোগ দিয়ে অনেক আহত মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা দেন। শেখ রাজ্জাক আলীর রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি মওলানা ভাসানীর হাতে। তিনি ন্যাপে যুক্ত হয়ে রাজনীতি শুরু করেন। এরপর তিনি যোগ দেন জাসদে। ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৬ আসনে জাসদের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন। ১৯৭৮ সালে তিনি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জাগো দল ও পরে বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে তিনি খুলনা-৬ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি কঠোর ভূমিকা পালন করেন। সেই সময় তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ খুলনা জেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন। খুলনা-৬ আসন থেকে তিনি ১৯৯১ সালে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আইন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। সে বছরই ৫ এপ্রিল তিনি ডেপুটি স্পিকার ও ১২ অক্টোবর স্পিকার নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে তিনি শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে প্রথম সার্ক স্পিকার্স সম্মেলনে যোগ দেন এবং সার্ক স্পিকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। একই আসন থেকে তিনি ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনের পর শেখ রাজ্জাক আলীর সভাপতিত্বেই জাতীয় সংসদে স্বল্প সময়ের অধিবেশনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অনুমোদন দেওয়া হয়।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পাননি শেখ রাজ্জাক আলী। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে খুলনা-২ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েও পরে তা প্রত্যাহার করে নেন। এই সময় বিএনপি সরকার গঠন করলে শেখ রাজ্জাক আলী যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার হিসেবে মনোনীত হন। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তিনি পদত্যাগ করে দেশে ফিরে আসেন। ২০০৬ সালে চারদলীয় জোট সরকারের আমলের শেষ দিকে তিনি অলি আহমেদের সঙ্গে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) গঠন করেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন। এর পর থেকে তিনি পরিবারের সঙ্গে নিভৃতে সময় কাটাতে থাকেন।
পরিবারের কথা : শেখ রাজ্জাক আলী ১৯৫৩ সালে প্রখ্যাত সমাজসেবী, ভাষাসৈনিক ও লেখিকা অধ্যাপক বেগম মাজেদা আলীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের পাঁচ মেয়ে নিজ নিজ নামে খ্যাতিমান ও প্রতিষ্ঠিত। বড় মেয়ে ড. রানা রাজ্জাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। মেজো মেয়ে ডা. সাহানা রাজ্জাক স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে খুলনায় কর্মরত। সেজো মেয়ে জার্মানিতে কর্মরত ডা. অ্যানা রাজ্জাক মেডিসিন ও আকুপাংচার বিশেষজ্ঞ। চতুর্থ মেয়ে লীনা রাজ্জাক চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট এবং কনিষ্ঠ মেয়ে ব্যারিস্টার ড. জনা রাজ্জাক ইউনিভার্সিটি অব দ্য ওয়েস্ট অব ইংল্যান্ডের আইন বিভাগের অধ্যাপক।
শেখ রাজ্জাক আলীর ঘনিষ্ঠদের মতে, বিএনপির রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে তিনি কিছুটা অভিমান করে রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। ২০১৩ সালের ১৫ জুন খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন।