হাকিম বলেন আইনানুগ নয়, পুলিশের দাবি ভিআইপি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার ব্যাপারে ম্যাজিস্টেটের কাছে নিজেরাই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তাঁরা তিনজন। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী থেকে চাকরিও হারান তাঁরা। তারপরও আদালতে হাজিরের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন। প্রিজনভ্যান থেকে আদালত পর্যন্ত আনার সময় অন্য আসামিদের হাতকড়া পরানো হলেও তাঁদের আনা হচ্ছে মুক্তভাবে। এর আগে আদালত বিষয়টিকে আইনসম্মত নয় বলে উল্লেখ করলেও আজ সোমবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
সকালে নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার আসামিদের হাজির করা হয়। এ সময় মামলার অন্য ২৭ আসামিকে হাতকড়া পরিয়ে হাজির করা হলেও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, মাসুদ রানা ও আরিফ হোসেনকে হাতকড়া না পরিয়ে আদালতে নেওয়া হয়।
এর আগে গত ১১ মার্চ সাত খুন মামলার আসামি ও সাবেক র্যাব কর্মকর্তাদের হাতকড়া না পরিয়েই আদালতে হাজির করা হলে এ ব্যাপারে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আপত্তির জবাবে সেদিন জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম এইচ এম শফিকুল ইসলাম ভবিষ্যতে এই মামলার ক্ষেত্রে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেন। আদালত বলেন, ‘আইনের চোখে সবাই সমান। কিন্তু যেভাবে এই তিন অভিযুক্তকে কাঠগড়ায় আনা হয়েছে, তা আইনসম্মত নয়।’
বিষয়টি উল্লেখ করে আজ প্রশ্ন করা হলে পুলিশ জানায়, তাঁরা ভিআইপি ডিভিশন পাওয়া বন্দী। তাই হাতকড়া ছাড়াই তাঁদের আদালতে আনা হয়েছে।
গাজীপুর পুলিশের ডিএসবি শাখার ডিআইউ-১ মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বন্দীদের কারাগারে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের। ওই দুই বন্দি ভিআইপি ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দি। ভিআইপি বন্দীদের জন্য নিয়ম হলো তাদের হাতকড়া পরানো যায় না।’
তবে কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা ওই দুই সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে হাতকড়া পরিয়েই দিয়েছিল। পরে পুলিশ কী করেছে তা তারা জানে না।
কাশিমপুর কারাগার পার্ট ১-এর জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা এনটিভি অনলাইনকে জানান, ‘আসামিদের কীভাবে নেওয়া হবে সেটা পুলিশের দায়িত্ব। পুলিশ যেভাবে চায় আমরা সেভাবেই নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিই্। এ ক্ষেত্রেও পুলিশ যেভাবে চেয়েছে আমরা সেভাবেই ব্যবস্থা করে দিয়েছি।’
কাদের হাতকড়া পরিয়ে আদালতে হাজির করা হবে সে সম্পর্কে পুলিশ বিধিতে কিছু নির্দেশনা দেওয়া আছে। পুলিশ বিধি অনুযায়ী, সাধারণত যেসব আসামি অনেক বেশি অপরাধী বা পালিয়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে অথবা কারো ক্ষতি করতে পারে এমন সম্ভাবনা থাকে সেসব আসামিকে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে আনা হয়। তবে সবার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি প্রযোজ্য নয়। যেমন, ভিআইপি বন্দীদের হাতকড়া পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয় না।
এদিকে ১৮৬৪ সালের কারাবিধির ৯১০ ধারা অনুযায়ী সাধারণত রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ও মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আদালতের নির্দেশেই প্রথম শ্রেণির বন্দীর মর্যাদা দেওয়া হয়। এতে তাঁরা সাধারণ বন্দীদের চেয়ে ভালো অবস্থায় থাকার সুযোগ পান।
তবে ২০১৪ সালে সরকার এই আইনটিকে সংশোধন করে এর খসড়া তৈরি করে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির সকল কর্মকর্তাই ডিভিশন পাবেন বলে খসড়ায় বলা হয়। তবে আইনটি এখনো পাস হয়নি।
তবে নারায়ণগঞ্জ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত কৌঁসুলি (এপিপি) ফজলুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘হাতকড়া পরিয়ে আসামিকে আদালতে আনতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। পুলিশ যদি মনে করে যে আসামি এভাবে নেওয়া নিরাপদ, তাহলে হাতকড়া ছাড়াই নিতে পারে। আর যদি হাতকড়া পরিয়ে আনা হয় তবে আদালতের ভেতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে নিয়ম অনুযায়ী হাতকড়া খুলে ফেলতে হবে।’
মামলার আসামিদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা এবং মেজর আরিফ হোসেনকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে সকাল ৯টায় নারায়ণগঞ্জের আদালতে আনা হয়।
বাদীর নারাজির আদেশ ৮ জুলাই
এদিকে এই মামলার নারাজির আদেশ আগামী ৮ জুলাই দেওয়া হবে। সকালে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম এইচ এম শফিকুল ইসলাম দুটি মামলার বাদী নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা ডা. বিজয় কুমার পালের বক্তব্য শুনে এই নির্দেশ দেন।
বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, নূর হোসেনের সহযোগী আলী মোহাম্মদ জবানবন্দিতে যাদের নাম বলেছে, তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেনি।
এর আগে গত ৮ এপ্রিল গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ দীর্ঘ তদন্ত শেষে আদালতে ৩৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ১১ মে সেলিনা ইসলাম বিউটি তদন্ত কর্মকর্তার দাখিলকৃত অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন দাখিল করেন। তবে চন্দন সরকারের মামলার বাদী ডা. বিজয় কুমার পাল আগে থেকেই সন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন।
চাঞ্চল্যকর এই মামলার অন্যতম আসামি র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এবং লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা ও মেজর আরিফ হোসেনকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে সকাল ৯টায় নারায়ণগঞ্জের আদালতে আনা হয়। অন্য ২৭ আসামিকে নারায়ণগঞ্জ কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়।
র্যাবের এই সাবেক তিন কর্মকর্তা এরই মধ্যে নিজেদের দোষ স্বীকার করে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দি দিয়েছেন।
গত বছরের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তাঁর বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম এবং আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহীম অপহৃত হন।
পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ছয়জনের ও ১ মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানায় নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও আইনজীবী চন্দন সরকারের মেয়ের জামাই বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে দুটি মামলা করেন।