সাত খুনে চার্জশিট দাখিল, তারেক-নূরসহ অভিযুক্ত ৩৫
নারায়ণগঞ্জে সাত খুন মামলায় র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানা, কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হয়েছে। আজ বুধবার জেলার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম চাঁদনী রূপমের আদালতে এই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুনুর রশীদ মণ্ডল অভিযোগপত্র দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি এনটিভি অনলাইনকে জানান, ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে ১৬ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। আদালত আগামী ১১ মে শুনানির দিন ধার্য করেছেন। তাদের মধ্যে ২২ জন কারাগারে, ১৩ জন পলাতক রয়েছেন।
বাদীপক্ষ অভিযোগপত্রে আরো গুরুত্বপূর্ণ আসামির নাম আসেনি বলে আশঙ্কা করছে। তবে পুলিশ সুপার এটিকে ত্রুটিমুক্ত অভিযোগপত্র দাবি করছেন। সরকারপক্ষের আইনজীবী জানান, প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়েছে মাত্র। আগামী ১১ মে এই প্রতিবেদনের ওপর শুনানি শেষে তা গ্রহণ করা হবে।
বিকেল সোয়া ৫টায় দুটি মাইক্রোবাসে করে সাত খুনের তদন্ত কর্মকর্তা ও তাঁর সঙ্গীরা আদালতে আসেন। এ সময় ছবি ধারণ করতে অস্থির হয়ে পড়েন গণমাধ্যমকর্মীরা। ১৬ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র এবং সিডিসহ ১৬২ ধরনের আলামত আদালতে জমা দিয়ে প্রায় ৪০ মিনিট পর তাঁরা বেরিয়ে যান। এই মামলা দুটিতে ১২৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
মামলার বাদী ও নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী কাউন্সিলর সেলিনা ইসলাম জানান, ‘আমি অনেক আশা করেছিলাম, নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর এই অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। কারণ, নূর হোসেন না থাকায় অনেক বিষয় গোপন থাকতে পারে। তাঁকে দেশে ফিরিয়ে এনে রিমান্ডে নিলে আরো অনেক বিষয় আসবে। আমি এজাহারে ছয়জনের নাম উল্লেখ করেছিলাম। তার মধ্যে একজনের নাম অভিযোগপত্রে এসেছে। বাকি পাঁচজনের নাম কেন এলো না সেটাই আমার ক্ষোভ।’
সেলিনা ইসলাম আরো জানান, ‘একটি রাস্তার কাজ নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। তারপর ১ ফেব্রুয়ারি যখন আমার স্বামীর ওপর হামলা হয়, তখন ওই পাঁচজনের সবার হাতে অস্ত্র ছিল। তাহলে তাদের নাম কেন অভিযোগপত্রে এলো না। আমি পর্যালোচনা করে এই অভিযোগপত্রের ওপর নারাজি দেব। আমি চাই, নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে এনে রিমান্ডে নেওয়া হোক। পরিকল্পনাকারী যারা তাদের নাম আসুক। এ ঘটনার আরো তথ্য আসুক।’
বাদীপক্ষের আইনজীবী ও নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘১০ মাস আগে নূর হোসেনকে ভারতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়নি। যদি তাঁকে ফিরিয়ে আনা হতো তাহলে এই অভিযোগপত্রে যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তার বাইরে আরো অনেকের নাম থাকত। বাদী সেলিনা ইসলাম মামলার এজাহারে ছয়জনের নামোল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র একজনের নাম অভিযোগপত্রে এসেছে। বাকি পাঁচজনকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। অথচ এই পাঁচজন বিভিন্ন সময়ে বাদীকে হুমকিও দিয়েছে। আমরা আদালত থেকে নকল উঠিয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বাদীর সাথে বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা কবর। তারপরই আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’
সরকারপক্ষের আইনজীবী ফজলুর রহমান জানান, তদন্ত কর্মকর্তা এ মামলায় ১২৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। এই মামলার ২১ জন আসামির এবং ১৭ জন সাক্ষীর জবানবন্দি পর্যালোচনা করে ৩৫ জনকে অভিযোগপত্রভুক্ত করেছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসেনি তাদের নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার সন্ধ্যায় তাঁর কার্যালয়ের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, এটি একটি চাঞ্চল্যকর মামলা। তদন্ত কর্মকর্তা সময় বেশি নিয়েছেন তা বলা যাবে না। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হয়নি। পেশাদারিত্ব বজায় রেখে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা হয়েছে।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তাঁর বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম এবং আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহীম অপহৃত হন। পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ছয়জনের ও ১ মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও আইনজীবী চন্দন সরকারের মেয়ের জামাই বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা মডেল থানায় দুটি মামলা করেন।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ১১-এর চাকরিচ্যুত তিন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, কমান্ডার এম এম রানাসহ ১৯ র্যাব সদস্যের মধ্যে ১৮ জন সাত খুনে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩১ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
সাত খুন মামলার প্রধান অভিযুক্ত আসামি আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন এ ঘটনার পর ভারতে পালিয়ে গেলে সেখানকার পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। বাংলাদেশ সরকার এখনো তাঁকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি।