যুক্তরাষ্ট্রে যুবলীগের আশ্রয়ে মিল্কি হত্যার আসামি!
যুক্তরাষ্ট্রে আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে আছেন যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কি হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল। সেখানে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সব ধরনের অনুষ্ঠানেই তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতা জানান, নিজ দলের একজন নেতাকে খুনের আসামি এভাবে প্রশ্রয় পাওয়ায় তাঁদের অনেকেই বিব্রত। দেশে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার হয়ে মিল্কি হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত এ আসামি এখন কাগজপত্রে সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য পেশ করে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
সর্বশেষ গত ৭ জুন ওয়াশিংটনে আওয়ামী যুবলীগের অনুষ্ঠানে আয়োজকদের সঙ্গেই মঞ্চে সক্রিয় দেখা যায় চঞ্চলকে। এর আগে গত ১৩ মে ফ্লোরিডা স্টেট আওয়ামী যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা অনুষ্ঠানের মঞ্চে হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল তাঁর। এসব অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতির ছবি রয়েছে এনটিভি অনলাইনের কাছে।
এ ছাড়া গত ২৫ এপ্রিল নিউইয়র্কে একটি মদের দোকানে (বার) মারামারি করে তারিকুল ও চঞ্চল দুজনই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কয়েকদিন পর তাঁরা জামিন পান বলে নেতাকর্মীরা জানান।
এর আগে গত ৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানেও অংশ নেন চঞ্চল। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আমীর হোসেন আমু।
সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল ঢাকা মহানগর যুবলীগের (উত্তর) সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। মিল্কি হত্যায় অভিযোগপত্রে তাঁর নাম এলে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। নেতাকর্মীরা জানান, এর পরপরই প্রভাবশালী কিছু নেতার সহায়তায় ভারত-সিঙ্গাপুর হয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী যুবলীগের আহ্বায়ক তারিকুল হায়দার চৌধুরীর আশ্রয়ে আছেন বলে তাঁরা অভিযোগ করেন।
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা জানান, চঞ্চল বর্তমানে নিউইয়র্কের জ্যামাইকা এলাকায় বসবাস করছেন।
এ ব্যাপারে জানতে ফোনে এনটিভি অনলাইনের কথা হয় তারিকুল হায়দার চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি দাবি করেন, চঞ্চলের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
‘আমার চোখে তিনি একজন বাঙালি’
তারিকুল হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘আমরা আমেরিকায় রাজনীতি করি। বাংলাদেশের চেয়ে এখানকার রাজনীতি টোটালি ডিফরেন্ট। এখানে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির চেয়ে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি অনেক স্ট্রং। আমরা যখন কোনো প্রোগ্রাম দেই, তখন সবাইকেই দাওয়াত দেই। নিউজ পেপার-টিভিকে বলি। এখন ওখানে বঙ্গবন্ধুর কথা যাঁরা শুনতে আসেন, আমরা তাঁদের স্বাগত জানাই। শেখ হাসিনার কথা যাঁরা বলেন, আমরা তাদের স্বাগত জানাই। এখন বাংলাদেশে যদি কেউ ক্রাইম করে আসেন, তবে সেটা এ দেশের (যুক্তরাষ্ট্র) সরকার দেখবে, এখানে আমাদের কিছু করার নেই। তিনি ক্রিমিনাল, নাকি চার্জশিটভুক্ত আসামি তা ইউএস গভর্নমেন্ট দেখবে। আমার চোখে তিনি একজন বাঙালি।’
‘আমি এখানকার রাজনীতি করি, আমি এখানে বড় হয়েছি, এখানে থাকি। আমার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে যে কাজগুলো করে সরকার, এখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের সে কথাগুলো আমি প্রোভাইড করি। জাস্ট সেই কাজগুলোই আমি করি,’ যোগ করেন তারিকুল হায়দার।
একজন বহিষ্কৃত নেতা, যাঁর বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ তাঁকে এভাবে আশ্রয় দেওয়া ঠিক হচ্ছে কি না –এমন প্রশ্নে তারিকুল বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে কোনো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট পেপার আমার কাছে আসেনি। কাজেই আমি বলতে পারব না কাকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ থেকে আদেশ গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এ যুবলীগ নেতা বলেন, ‘যেহেতু আমাদের কাছে কোনো পেপার আসে নাই, তাই আমরা এ বিষয়ে কিছু জানিও না। এখন জানলাম, ওনার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। আর আমরা এমন কোনো লোক আমাদের দলে চাইব না যাঁরা আমাদের দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ডাইরেক্ট শেখ হাসিনার লোক। শেখ হাসিনার দলের মধ্যে যারা গণ্ডগোল করবে, তাদের আমরা প্রশ্রয় দেব না।’
‘ওয়ারেন্ট জারি আছে’
মিল্কি হত্যার ঘটনায় করা মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মনসুর রিপন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা শুনেছি এবং পত্রপত্রিকায় পড়েছি যে, মামলার অন্যতম আসামি চঞ্চল বিদেশে পলাতক। সেই সঙ্গে জামিনের শর্ত ভঙ্গ করে এ মামলার অন্যতম আরেক আসামি লোপাও এখন আর আদালত হাজিরা দেন না। আমরা শুনেছি, তিনি ভারতে আছেন।’ এ ছাড়া চার্জশিটভুক্ত অন্য আসামিদের সবাই জামিনে আছেন বলে জানান তিনি।
পলাতক চঞ্চলকে ফিরিয়ে আনার জন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে কি না এ বিষয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রচলিত যে আইন আছে, সেটা মেনে তাঁকে দেশে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত আছে। অলরেডি তাঁর বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু আছে। আর তিনি যেহেতু বাংলাদেশের ভেতরে নাই, সেহেতু এখানে বন্দিবিনিময় চুক্তি এবং বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য দেশগুলোর যে একস্ট্র্যাডিশন চুক্তি আছে, তার সঠিক ব্যবহার করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারি করে তারপর তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। এখানে যেহেতু শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের সমন্বয়ে কাজটি হয় সেহেতু এটা সময়ের বিষয়। তবে প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।’
তদন্তে সহযোগিতা পাচ্ছেন না কর্মকর্তা
আইনজীবী রিপন বলেন, মামলার বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা উত্তম কুমার মামলার মূল রহস্য উদঘাটনের লক্ষ্যে ও রিয়াজুল হক মিল্কীর হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত আসামি শনাক্তকরণ টেস্ট আইডেন্টিফিকেশন প্যারেড আবেদন করা হয় গত ২০ মে। কিন্তু বিচারক তা আমলে না নিয়ে ওই দিনই আবেদন নামঞ্জুর করেন। ফলে তদন্তের ক্ষেত্রে এটা একটা বাধা। সত্যিকার অর্থে প্রকৃত আসামি কারা সেটা উদঘাটনের ক্ষেত্রে এটা একটা বাধা। তদন্ত ক্ষেত্রে তো এটা একটা বাধাই। সেই সঙ্গে সত্য উদঘাটনের ক্ষেত্রেও এটা একটা বাধা।
এই আইনজীবী আরো বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তারা সত্যিকার অর্থেই যারা মামলার আসামি অর্থাৎ সত্যিকার অপরাধী তাদের খুঁজে বের করার জন্য ফৌজদারি দণ্ডবিধি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে আসামিদের নাম বলেছে, তাদের মধ্যে মিল্কী মার্ডারের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা আছে, তাদের ক্লু খুঁজে বের করার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা যথাযথ সহযোগিতা পাচ্ছেন না।
এসব ব্যাপারে কথা বলতে তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে একাধিক দিন যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
‘যারা দেশে আছে, তাদেরই ধরতে পারছে না’
মিল্কীর স্ত্রী ফারজানা খানম অভিযোগ করেন, যারা এ হত্যাকাণ্ডের আসামি তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়ার আগেই তারা জামিনে বের হয়ে এসেছে। তিনি বলেন, যারা দেশে আছে, তাদেরই ধরতে পারছে না, দেশের বাইরে যারা আছে, তাদের কীভাবে ধরবে? দেশে যারা আছে তাদেরও তো ধরে নিচ্ছে না। তাদের ধরে নিয়ে রিমান্ডে নিলেই তো আসল সত্য বের হয়ে আসে।
ফারজানা আরো বলেন, ‘ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট জারির মাধ্যমে দেশের বাইরে পলাতক আসামিকে আনার জন্য লিখিত কোনো আবেদন করা হয়নি। তবে আমি মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে রেড অ্যালার্ট জারি করে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলেছি।’
সব সময় আতঙ্কে থাকেন বলে জানান ফারজানা খানম। সেই সঙ্গে হত্যার এতদিনেও বিচারের তেমন কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় হতাশায় পরিবারের সদস্যরা।
২০১৩ সালের ২৯ জুলাই দিবাগত রাতে রাজধানীর গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন মিল্কী। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরো চার-পাঁচজনকে আসামি করে গুলশান থানায় মামলা করেন মিল্কির ভাই মেজর রাশেদুল হক খান। আর মিল্খী হত্যাকাণ্ডের পর তারেক ও চঞ্চলকে আওয়ামী যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এ ঘটনায় ওই দিন রাতেই মিল্কী হত্যার আরেক আসামি যুবলীগের (দক্ষিণ) যুগ্ম সম্পাদক এস এম জাহিদ সিদ্দিক তারেককে উত্তরার ফরচুনা হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরের দিন ৩০ জুলাই র্যাবের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের বন্দুকযুদ্ধে মারা যান তারেক। মিল্কী হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে চঞ্চলকে খুঁজে পাননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এর পর থেকে নানা গুঞ্জন চলতে থাকে তাকে ঘিরে। এর মধ্যেই শোনা যায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন।