মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরে বাকি তিন প্রক্রিয়া
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে আরো তিনটি আইনি প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। এ তিনটি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর রায় কার্যকর করতে আর বাধা থাকবে না বলে মনে করেন আইনবিদরা।
প্রথমত, আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রকাশ করতে হবে। এটি মুজাহিদকে পড়ে শুনানোর পর তিনি রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) করার সুযোগ পাবেন। এ জন্য তিনি রায় হাতে পাওয়ার পর ১৫ দিন সময় পাবেন। দ্বিতীয় আইনি প্রক্রিয়া শুরু এখান থেকে। রায় রিভিউ আবেদনের পর এ বিষয়ে আপিল বিভাগে শুনানি হবে। শুনানি শেষে তাঁর আবেদন খারিজ হলে এ বিষয়ে রায়ের অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর আসামির আদালতের সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ। বাকি থাকল তৃতীয় ও শেষ প্রক্রিয়া : এ ক্ষেত্রে সব দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ পাবেন জামায়াত নেতা।
কারাবিধি অনুযায়ী, একজন আসামি রায় রিভিউ বা রায় পুনর্বিবেচনার রায় হওয়ার পর থেকে তিনি প্রাণভিক্ষা চাওয়ার জন্য সাতদিন সময় পেয়ে থাকেন। এরপর তাঁকে ২১ দিনের আগে নয় এবং ২৭ দিনের বেশি নয় এমন সময়ের মধ্যে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে। তবে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সময় নিয়ে আসামিপক্ষ এবং রাষ্ট্রপক্ষের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। তবে জামায়াত নেতা মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লার ফাঁসির কার্যকরের সময় এই বিধি মানা হয়নি। এর কারণ হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুব আলম বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ক্ষেত্রে কারাবিধি প্রযোজ্য হবে না।
মাহবুবে আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সময় নিয়ে কোনো সময় সীমা নেই। যে কারণে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হওয়ার পর প্রাণভিক্ষা বাতিল হলে সরকার চাইলে যেকোনো দিন ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে।
অপরদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সময় সাতদিন দিতে হয়। এরপর আসামি প্রাণভিক্ষা না চাইলে অথবা প্রাণভিক্ষা আবেদন বাতিল হলে কারাবিধি অনুযায়ী একজন আসামিকে ২১ দিনের আগে নয় এবং ২৭ দিনের পরে নয় এমন সময়ে ফাঁসি কার্যকর করতে হয়।
রায় কার্যকরের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য পূর্ণাঙ্গ রায় না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর দণ্ড কার্যকর করতে সরকার উদ্যোগ নিতে পারবে। আর আপিল বিভাগের দেওয়া সময় অনুসারে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের জন্য ১৫ দিন সময় পাবেন আসামিপক্ষ। যখনই পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হবে, তখনই দণ্ড কার্যকর প্রক্রিয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে।’
গত বছর ৩ নভেম্বর আপিল মামলার চূড়ান্ত রায়ে কামারুজ্জামানকে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ওই দিন সংক্ষিপ্ত আদেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত। চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পায়। এরপর ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানরে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করলে আসামির আইনজীবীরা ৫ মার্চ রিভিউ আবেদন করে। এতে করে পরোয়ানার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। সে সময় সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটির প্রাক্কালে কামারুজ্জামানের পক্ষে করা সময়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১ এপ্রিল শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করেন আপিল বিভাগ। শুনানি শেষে ৬ এপ্রিল তাঁর পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। এরপর প্রাণভিক্ষা না চাওয়ায় ১১ এপ্রিল শনিবার রাতে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে জামায়াতের অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। কাদের মোল্লার মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। ওই দিন ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আপিল বিভাগ। ছয়টির মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল ২-এর ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা বাড়িয়ে চূড়ান্ত এ রায় প্রদান করেন সর্বোচ্চ আদালত। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় এবং ১২ ডিসেম্বর রাতে কার্যকর হয় কাদের মোল্লার ফাঁসি। এ সময় তিনি চূড়ান্ত রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে পারবেন কি না এ বিষয়ে বিতর্ক শুরু হয় আসামি এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে। এ কারণে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের সময় ১০ ডিসেম্বর রাতে নির্ধারিত হলেও মাত্র দুই ঘণ্টা আগে তাঁর আইনজীবীরা দুটি আবেদন করেন। একটিতে ওই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হয় এবং দ্বিতীয় আবেদনে রায় পুনর্বিবেচনা করে কাদের মোল্লার খালাসের আবেদন করা হয়। সর্বোচ্চ আদালত এসব আবেদন খারিজ করে দিলে কার্যকর করা হয় ফাঁসির দণ্ড। কিন্তু রিভিউ গ্রহণ ও খালাসের আবেদন একত্রে খারিজ হওয়ায় এ ধরনের মামলায় রিভিউ আদৌ চলবে কি না, সে অস্পষ্টতা থেকে যায়।
রিভিউয়ের এ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় গত বছরের ২৫ নভেম্বর। এতে যুদ্ধাপরাধের মামলাতেও সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করা যাবে বলে রায় প্রদান করেন আপিল বিভাগ। ফলে কামারুজ্জামানসহ অন্য সাজাপ্রাপ্তরাও তাঁদের দণ্ডাদেশের রিভিউয়ের আবেদন করার সুযোগ পাচ্ছেন। একই সঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন সাজার রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষও একই আবেদন করতে পারবেন।