বাবা-মা যখন উপলব্ধি করেন তখন ঐশী উচ্ছন্নে গেছে
ঐশী রহমানের পরিবারে মানসিক ভারসাম্যহীনতার ইতিহাস রয়েছে। চিকিৎসকরা ঐশীর মধ্যেও মানসিক সমস্যা পেয়েছেন। মানসিকভাবে বিচ্যুতির কারণেই সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়া আসামি (ঐশী) এ জোড়া খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে।
আজ রোববার রায় প্রদানকারী হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের স্বাক্ষরের পর ৭৮ পৃষ্ঠার প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে এসব মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।
গত ৫ জুন আলোচিত এ মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে অনুমতি চেয়ে আবেদন) ও আসামির আপিল শুনানি শেষে হাইকোর্ট ঐশীর মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
রায়ে আদালত বলেন, তার (ঐশী) বাবা পুলিশে ও মা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। তারা তাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেননি। তারা যখন উপলব্ধি করছিলেন ঠিক সে সময় তার জীবনে মাদকাসক্তি ও উচ্ছন্নে চলে গেছে।
রায়ে উল্লেখ করা হয়, সন্তানদের জন্য বাবা-মা ও অভিভাবকই হলেন প্রাথমিক শিক্ষক। সে হিসেবে সন্তানদের জন্য ভালো পরিবেশ এবং বাবা-মায়েদের সময় দেওয়া প্রয়োজন।
রায়ে আরো বলা হয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ডকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আমাদের দেশে তা বিলপ্ত করার পরিবেশ আসেনি। জনসংখ্যা বেড়েছে। ফলে অপরাধপ্রবণতা যেমন বেড়েছে, তেমনি অপরাধের ধরনও পাল্টেছে। এ অবস্থায় মৃত্যুদণ্ড রহিত করা যুক্তি-সঙ্গত নয়। আবার মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নয়। এটা কার্যকর করলেই যে সমাজ থেকে অপরাধ দূর হয়ে যাবে, বিষয়টি তা নয়। কম সাজাও অনেক সময় সমাজ থেকে অপরাধ কমাতে সুস্পষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
রায়ে উল্লেখ করা হয়, মৃত্যুদণ্ড কমাতে সমাজের প্রতিটি স্তরে সুশাসন ও মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। নিম্ন আদালতে ঐশীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিষয়ে হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে বলেন,নিম্ন আদালত সামাজিক অবক্ষয় বিবেচনায় নিয়ে কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে এ রায় দিয়েছেন। কিন্তু সাজা নির্ধারণ ও বিচারের ক্ষেত্রে এ ধরনের আবেগ প্রদর্শনের সুযোগ নেই। আদালত আইনগত তথ্যাদি ও প্রমাণাদি বিবেচনায় নেবে। যেখানে একজন নারী হিসেবে ১৯ বছর বয়সে এ ধরনের অপরাধ করেছে।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, ঘটনার সময় ঐশী রহমানের বয়স ছিল ১৯ বছর। তার বিরুদ্ধে অতীতে ফৌজদারি কোনো অপরাধের নজিরও নেই। এ ছাড়া সে ঘটনার দুইদিন পরই স্বেচ্ছায় থানায় আত্মসমর্পণ করে।
রায়ে রাজধানীর চামেলীবাগের বাসায় পুলিশ কর্মকর্তা বাবা মাহফুজুর রহমান ও মা স্বপ্না রহমানকে হত্যার মামলায় তাদের মেয়ে ঐশীকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করেছেন হাইকোর্ট। এর কারণ হিসেবে পাঁচটি যুক্তি দেখিয়েছেন উচ্চ আদালত।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে দণ্ড কমানোর ব্যাখ্যায় আদালত বলেন, পাঁচটি কারণে ঐশীর মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়েছে। এগুলো হলো :
এক. হত্যাকাণ্ডের সময় ঐশী মাদকাসক্ত ছিল এবং ১৪ বছর বয়স থেকেই সে সিসা, ইয়াবা,গাঁজা, ফেনসিডিলের মতো নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করত। তাই সে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল।
দুই. ঐশী বংশগতভাবে মানসিক রোগী। তার চাচা-দাদি-খালা অনেকের মধ্যেই মানসিক রোগের লক্ষণ আছে, যা তার মধ্যেও ছোটবেলা থেকে বিদ্যমান।
তিন. হত্যাকাণ্ডের ঘটনার দ্বিতীয় দিনের মাথায় ঐশী আত্মসমর্পণ করেছে। এতে বোঝা যায়, সে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
চার. ঘটনার সময় ঐশীর বয়স ছিল ১৯ বছর। এ বয়সের একটি সন্তানকে তার বাবা-মা যথাযথভাবে দেখভাল করেননি। ফলে ঐশী ছোটবেলা থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল।
পাঁচ. ঐশীর বাবা-মা দুজনেই সন্তানের লালনপালন বিষয়ে উদাসীন ছিলেন। এ কারণে ছোটবেলা থেকেই সে স্নেহবঞ্চিত হয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
এর আগে ২০১৫ সালে ঐশী রহমানকে দুবার মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। প্রত্যেক মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়, অনাদায়ে দুই বছর কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। একটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর অন্যটি সরাসরি বাতিল হয়ে যাবে। একই সঙ্গে ঐশীর বন্ধু মিজানুর রহমান রনিকে দুই বছর কারাদণ্ডাদেশ ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। মামলার অপর আসামি আসাদুজ্জামান জনিকে খালাস দেন আদালত।
ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহমেদ এ রায় ঘোষণা করেন।
২০১৫ সালের ৬ ডিসেম্বর ২৫টি যুক্তি দেখিয়ে ঐশী রহমান রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে।
২০১৪ সালের ৯ মার্চ ঐশীকে প্রধান আসামি করে তিনজনের বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পরিদর্শক আবুল খায়ের।
২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর মালিবাগের চামেলীবাগের বাসা থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমানের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পরের দিন ১৭ আগস্ট নিহত মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই মো. মশিউর রহমান রুবেল পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। একই দিন পল্টন থানায় আত্মসমর্পণ করে ঐশী রহমান।