আড়াই মাস আগেই থানায় গিয়েছিলেন নিলয়!
ব্লগারদের লাশের মিছিলে এবার যুক্ত হলো আরো একজনের নাম, খুন হলেন ব্লগার নিলয় নীল। রাজধানীর খিলগাঁওয়ের গোড়ান এলাকায় নিলয় নীল নামের ওই ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। আজ শুক্রবার দুপুরে ভাড়াটিয়া বেশে বাসায় ঢুকে তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
নিলয় নীল ব্লগে ও ফেসবুকে ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সরব ছিলেন। সম্পৃক্ত ছিলেন গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গেও। এ ছাড়া তিনি ছিলেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলেরও সদস্য।
প্রায় আড়াই মাস আগে ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে নিজের জীবন সংশয়ের কথা প্রকাশ করেছিলেন নিলয়। জানিয়েছিলেন তাঁকে অনুসরণ করার কথা। বিষয়টি নিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গিয়েছিলেন নিলয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা করতে পারেননি।
গত ১৫ মে ফেসবুকে নিলয় লিখেছিলেন, ‘জিডি করতে যেয়ে আরো উদ্ভট পরিস্থিতির সম্মুখীন হই।’ তিনি আরো লেখেন, ‘ঘটনাস্থলের আওতায় থাকা একটি থানায় গেলে তারা জিডি নিল না, তারা বলল আমাদের থানার অধীনে না, এটা অমুক থানার অধীনে পড়েছে ওখানে যেয়ে যোগাযোগ করুন, আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ছেড়ে চলে যান।’
তবে নিলয় কোন থানায় জিডি করতে গিয়েছিলেন তা ওই স্ট্যাটাসে জানাননি।
নিলয়ের ফেসবুক ওয়াল থেকে সেই স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
“আমাকে দুজন মানুষ অনুসরণ করেছে গত পরশু। ‘অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার’ প্রতিবাদে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে যোগদান শেষে আমার গন্তব্যে আসার পথে এই অনুসরণটা করা হয়। প্রথমে পাবলিক বাসে চড়ে একটা নির্ধারিত স্থানে আসলে তারাও আমার সাথে একই বাসে আসে। এরপর আমি লেগুনায় উঠে আমার গন্তব্যস্থলে যাওয়া শুরু করলে তাদের মধ্যে একজন আমার সাথে লেগুনায় ওঠে। লেগুনায় বসে আমার মনে পড়ে বাসে তো এই ব্যক্তিই ছিল কিন্তু তারা তো দুজন ছিল। মনে মনে ভাবি হতেই পারে, একজনের গন্তব্য অন্যদিকে তাই সে চলে গেছে।
এ পর্যন্ত ব্যাপার স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে লেগুনায় বসে সেই যুবক ক্রমাগত মোবাইলে টেক্সট করছিল যা দেখে আমার সন্দেহ হয়। আমি আমার নির্ধারিত গন্তব্যস্থলের আগেই নেমে গেলে আমার সাথে সেই তরুণও নেমে পড়ে। আমি বেশ ভয় পেয়ে সেখানের একটি অপরিচিত গলিতে ঢুকে যাই। পরে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ওই তরুণের সঙ্গে বাসে থাকা আরেক তরুণ এসে যোগ দিয়েছে এবং তারা আমাকে আর অনুসরণ না করে গলির মুখেই দাঁড়িয়ে আছে। তখন থেকে আমি নিশ্চিত হলাম যে আমাকে অনুসরণ করা হচ্ছে কারণ তাদের দুজনের গন্তব্য একই জায়গায় হলেও তারা ভিন্নভাবে এসেছিল এবং আমাকে অনুসরণ করেছিল। আমি গলির আরো অনেক ভেতরে যেয়ে রিকশা নিয়ে হুড ফেলে আমার গন্তব্যস্থলে যাই এবং পরে কাছের এক বন্ধুর সহযোগিতায় আপাত নিরাপদেই পৌঁছাই।‘
‘এই ঘটনায় জিডি করতে যেয়ে আরো উদ্ভট পরিস্থিতির সম্মুখীন হই। প্রথমেই এক পুলিশ অফিসার ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছিল যে এই ধরনের জিডি পুলিশ নিতে চায় না কারণ ব্যক্তির নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাপারে যে কর্মকর্তা জিডি গ্রহণ করবে তার অ্যাকাউন্টেবিলিটি (জবাবদিহিতা) থাকবে সেই ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। আর যদি ওই ব্যক্তির কোনো সমস্যা হয়, সেই ক্ষেত্রে ওই পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলার জন্য চাকরি পর্যন্ত চলে যেতে পারে। থানায় জিডি করতে ঘুরেও একই চিত্র দেখলাম, অনুসরণকালে অনেকগুলো থানা অতিক্রম করার জন্য গতকাল ঘটনাস্থলের আওতায় থাকা একটি থানায় গেলে তারা জিডি নিল না, তারা বলল আমাদের থানার অধীনে না, এটা অমুক থানার অধীনে পড়েছে ওখানে যেয়ে যোগাযোগ করুন, আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ছেড়ে চলে যান।”
এর আগেও দেশে একের পর এক ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় আন্দোলন চলার সময় ব্লগার রাজীব হায়দারকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতে হত্যা করা হয়। এরপর বইমেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসির কাছে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ব্লগার অভিজিৎ রায়কে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর ঠিক একই কায়দায় দিনেদুপুরে হত্যা করা হয় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে। নিলয়ের আগে সবশেষে সিলেটে হত্যা করা হয় বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলের আরেক সদস্য ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে।