ক্লাসের ক্যাপ্টেনকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠালেন শিক্ষক
এবার ঝিনাইদহ জেলা শহরের কাঞ্চননগর স্কুল অ্যান্ড কলেজে ছাত্রকে বেদম পেটালেন শিক্ষক। আহত ছাত্রের নাম সাইমুন হক ওরফে ইফতি। চতুর্থ শ্রেণির মেধাবী ছাত্র ও ক্লাস ক্যাপ্টেন ইফতিকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার বেলা ১২ টা ১০ মিনিটের দিকে চতুর্থ শ্রেণির কক্ষে ইফতিকে পেটানো হয়।
গ্রামীণফোনে কর্মরত আজমল হক ঝান্টু ও সেলিনা আক্তারের একমাত্র ছেলে ইফতি। চিকিৎসকরা বলেছেন, ইফতির বাঁ হাঁটুতে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
জেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বিকেলে আহত ছাত্রকে দেখতে হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন। সে সময় তিনি আহত ছাত্রকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ঘটনাটি দুঃখজনক। জড়িত ব্যক্তির শাস্তি হওয়া উচিত বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কিভাবে শিক্ষক মারপিট করেছে সে বিষয়ে হাসপাতালে ভর্তি আহত ছাত্র সাইমুন হক ওরফে ইফতি জানায়, বেলা ১২ টা ১০ মিনিটের সময় ক্লাসের গণিত বিষয়ের শিক্ষক কবীর উদ্দিন তাকে কাঠের তৈরি স্কেল দিয়ে বেদমভাবে মারপিট করতে থাকে। মারপিটের একপর্যায়ে তার বাঁ পায়ে আঘাত করতে থাকেন ওই শিক্ষক। এতে সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে বসিয়ে রাখা হয় ক্লাস রুমে।
কেন তাকে মারপিট করা হয়েছে এমন প্রশ্নের উত্তরে সে জানায়, সবগুলো অঙ্ক হওয়ার পরেও স্যার তাকে মেরেছে।
ইফতি আরো জানায়, পরবর্তীতে খায়রুল ইসলাম নামের অন্য এক শিক্ষক ক্লাসে আসেন। তাকে দেখে অন্যসব ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালেও ইফতি উঠে দাঁড়াতে পারে না। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। উঠে সম্মান জানাতে না পারার অপরাধে কান ধরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন ক্লাসে আসা নতুন শিক্ষক খায়রুল। এ সময় উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে যায় সে। এরপর ঘটনাটি জানাজানি হয়ে পড়ে।
ইফতির বাবা আজমল হক ঝান্টু অভিযোগ করেন, তার ছেলেকে মারপিট করে আহত করার পরেও স্কুল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেননি। ঘটনার প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা পর তাঁকে ফোনে খবর দেওয়া হয়। তখন তিনি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বিষয়খালী বাজারে ছিলেন এবং সেখান থেকে ফিরে বেলা ২টার দিকে আহত ছেলেকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন তিনি।
অভিযুক্ত শিক্ষক কবীর উদ্দিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ইফতি চতুর্থ শ্রেণির মেধাবী ছাত্র ও ক্লাস ক্যাপ্টেন। ক্লাসে ছোটাছুটি করার কারণে ইফতিকে কাঠের স্কেল দিয়ে পিটিয়ে আহত করেছেন বলে স্বীকার করেছেন তিনি।
কবীর উদ্দিন আরো জানান, ছাত্র-ছাত্রীদের চড়-থাপ্পর মারার অপরাধে ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৮ বার কারণ দর্শানোর নোটিস খেয়েছেন তিনি। একবার তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় বলে অকপটে স্বীকার করেন। স্কুল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব লোক হওয়ার কারণে চাকরি যায়নি বলে দাবি তাঁর।
অন্য দিকে স্কুলটির অধ্যক্ষ প্রদীপ কুমার ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তিনি প্রাথমিকভাবে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করতে চাননি। বিকেলের দিকে ওই ছাত্রের অবস্থা বেগতিক হলে ইংরেজির শিক্ষক আশরাফুল ইসলামসহ কয়েকজন শিক্ষক সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে আসেন। ছাত্রের অবস্থা দেখে সে সময় অধ্যক্ষ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ঘটনার সাথে জড়িত খণ্ডকালীন ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অধ্যক্ষের ভাষায়, একই ধরনের ঘটনায় এর আগে কয়েক দফায় শিক্ষক কবীর উদ্দিনকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হয়েছিল। একবার সাময়িকভাবে বরখাস্তও করা হয় ওই শিক্ষককে।
তবে মারপিটের কারণে অসুস্থ শিশুটিকে কেন প্রায় দুই ঘণ্টা চিকিৎসা না দিয়ে শ্রেণি কক্ষের সামনে বসিয়ে রাখা হলো এমন প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি অধ্যক্ষ প্রদীপ।
ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের ৮ নম্বর বিছানায় যখন অসুস্থ ইফতি ছটফট করছে, তা দেখে বাবা-মায়ের চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। ঠিক তখন স্কুলটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য কঠোর ভাষায় হুমকি দেন। তাঁর কথোপকথন সংরক্ষিত আছে। একপর্যায়ে তিনি বলেন, খণ্ডকালীন ওই শিক্ষককে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে ।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক মো. জাকির হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আসাদুজ্জামান বলেছেন, প্রশাসন থেকে অসুস্থ ছাত্রের চিকিৎসার খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে এবং জেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার আলমগীর হোসেনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক আরো জানান, সব শেষ অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষার সময় নিয়ম অমান্য করার অপরাধে স্কুলটির প্রধান শিক্ষক/অধ্যক্ষ প্রদীপ কুমারকে কেন্দ্র সচিবের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।
সব শেষ আহত ছাত্রের বাবা অভিযোগ করে এনটিভি অনলাইনকে বলেছেন, ঘটনাটি নিয়ে সংবাদকর্মীদের কাছে মুখ না খুলতে প্রভাবশালী মহল থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে তাঁকে।
এর আগে ঝিনাইদহ সরকারি বালক বিদ্যালয়, হরিণাকুণ্ডুর মোকিমপুর হাইস্কল, ঝিনাইদহ শিশুকুঞ্জু স্কুল অ্যান্ড কলেজে ছাত্র পেটানোর একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটি হলেও জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এতে করে অভিভাবক মহলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে।