আলো ছড়াতে গিয়ে তাঁরা অন্ধকার কারাগারে!
ছিন্নমূল ও বস্তির শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করাই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। অথচ সেই তাঁদের আজ দিন কাটাতে হচ্ছে অন্ধকার কারাগারে। যে শিশুদের আলোর পথে আনতে নিরলসভাবে কাজ করে চলছিলেন, সেই শিশুদের পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে।
urgentPhoto
মানবপাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে ‘অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের চার সদস্যকে।
প্রতিষ্ঠানটির বনশ্রী শাখা থেকে উদ্ধার করা ‘পাচারের অপেক্ষায়’ থাকা শিশুরাও জানিয়েছে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের দেওয়া শিক্ষায় আলোকিত হওয়ার কথা। জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করা হতো না বরং অনেক আদর-যত্ন করা হতো। তারা আগে লেখাপড়া করতে পারত না। এখন তারা অনেক কিছু জানে। তারা কম্পিউটারও চালাতে পারে।
গ্রেপ্তার হওয়া আরিফুর রহমান, হাসিবুল ইসলাম সবুজ, জাকিয়া সুলতানা ও ফিরোজ আলম শুভর মতো শতাধিক স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণী কাজ করেন ‘অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে’। সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই কমপক্ষে পাঁচ হাজার শিশুকে একটু ভালো জীবন দেওয়ার জন্য কাজ করছে সংগঠনটি।
সংগঠনের অন্য সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছিন্নমূল ও বস্তির শিশুদের মাদক থেকে দূরে রাখা এবং উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী ২০১৩ সালে নিজেদের অর্থে গড়ে তুলেছিলেন এই সংগঠন। এরপর হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়েছে সংগঠনটি। বেড়েছে কলবর। কাজের প্রয়োজনে নেওয়া হয়েছে সরকারের অনুমোদন। তবে কিছুদিন আগে সেই মহৎ উদ্যোগেই হঠাৎ নেমে এসেছে দুর্যোগ।
পাচারের উদ্দেশ্যে শিশুদের জড়ো করা হয়েছে এমন অভিযোগে গত ১২ সেপ্টেম্বর ওই প্রতিষ্ঠানটির বনশ্রী শাখা থেকে ১০টি শিশুকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। আর মানবপাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে প্রতিষ্ঠানটির চার সদস্যকে। দুদিনের রিমান্ড শেষে গত বৃহস্পতিবার কারাগারে পাঠানো হয়েছে তাঁদের। আর উদ্ধার করা শিশুদের গাজীপুরের কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।
অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের সমন্বয়কারী জেরীন আক্তার বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম খাওয়া-দাওয়া আর পড়াশোনার মধ্যে না থাকুক, ওরা যেন নিজেরা তিন বছর পর কিছু করতে পারে। তার জন্য প্রজেক্টের ব্যবস্থা করি। কম্পিউটার চালানো, হাতের কাজ শেখানো হয় এবং তাদের কথা ও ব্যবহার পরিবর্তন করি।’
ফাউন্ডেশনের আরেক সদস্য সানাউল্লাহ নাঈম বলেন, ‘আমরা ছাত্ররা নিজের টাকা বাঁচিয়ে এবং বন্ধুদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে মানবসেবা কিংবা পথশিশুদের নিয়ে কাজ করতে চাই। আর আমাদের বিরুদ্ধে যদি শিশুপাচারের মামলা হয় তাহলে আমাদের মতো যারা ভবিষ্যতে এ ধরনের সংগঠন গড়ে তুলতে চাইছে তাঁরা আর সাহস পাবে না।’
ছিন্নমূল ও পথশিশুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির নানা উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ থেকে নানা তথ্য পাওয়া যায়। সেখানে শিশুদের খাওয়া, মজার শৈশব উপহার দেওয়ার পাশাপাশি কম্পিউটার বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের প্রশিক্ষণ দেওয়ারও প্রমাণ মেলে। এমনকি মানবপাচারের অভিযোগ ওঠা আরিফুর রহমানের ফেসবুক অ্যাকাউন্টেও শিশুদের নিয়ে কাজ করার বিভিন্ন ছবি দেখা যায়।
এদিকে প্রতিষ্ঠানটির চার সদস্যকে গ্রেপ্তার ও মানবপাচারের মামলার পর ফুঁসে উঠেছেন নসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা। বিভিন্ন পেজ ও ব্যক্তি এই গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে নিজেদের মতামত জানাচ্ছেন। সবাই একবাক্যে বলছেন, সমাজের অবহেলিত মানুষদের সহায়তা করতে গিয়ে যদি এভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয়, তাহলে আর কেউ কাউকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। সেজন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গ্রেপ্তার চারজনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে অনুরোধ করেছেন তাঁরা।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, ‘তাঁরা (অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন) যে কাগজপত্র দিয়েছেন তা আমরা খতিয়ে দেখছি। আর তাঁরা যে মন্ত্রণালয়ের কথা বলেছেন সেখানে আমরা যোগাযোগ করছি। এগুলো সঠিক কি না তা জানার চেষ্টা চলছে।’