গাড়ি চুরি : আ.লীগ নেতার আপস, দ্রুত জামিন
খুলনার খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ কিসমত আলীসহ তিন আসামিকে গাড়ি চুরির একটি মামলায় জামিন দিয়েছেন আদালত। গ্রেপ্তারের মাত্র নয়দিনের মাথায় গত ২১ সেপ্টেম্বর বিশেষ আবেদনের ভিত্তিতে তাঁরা জামিন নিয়েছেন।
মামলাটি দণ্ডবিধির ৩৮১/১০৯ ধারায়। সেটি জামিন অযোগ্য ধারা হওয়া সত্ত্বেও দ্রুত তাঁদের জামিন দেওয়া নিয়ে আদালতপাড়ায় বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
এর আগে ২০ সেপ্টেম্বর কিসমত আলীদের আইনজীবী জামিন চেয়ে আবেদন করলে আদালত তা নাকচ করে দেন। একদিন পরেই বিশেষ আবেদনের ভিত্তিতে তাঁরা ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) মারুফ হোসেনের আদালত থেকে জামিন নেন। আদালত তাঁদের ১০ হাজার টাকা করে মুচলেকায় জামিন দেন।
আদালতের একাধিক সূত্র জানায়, সিএমএম আদালতে আসামির জামিন নাকচ করা হলে সিএমএমের প্রধান বিচারকের কাছে বিশেষ জামিনের আবেদন করা যায়। সে ক্ষেত্রে সিএমএমের প্রধান বিচারক তিন বা চারদিন পরে জামিন শুনানির জন্য দিন ঠিক করে দেন। কিন্তু একদিনের মাথায় জামিন শুনানির দিন নির্ধারণ করাটা একবারে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
কিসমত আলীর জামিন আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দরখাস্তে কোনো অসুস্থতা বা পারিবারিক সমস্যার কথা উল্লেখ নেই।
সংশ্লিষ্ট আদালতের জেনারেল রেকর্ডিং অফিসার (জিআরও) মাহমুদুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, জামিনে বাদীর কোনো আপত্তি নেই বলে বিচারক জামিন দিয়েছেন। এ মামলায় সব আসামি জামিন পেয়ে গেছেন।
কিন্তু আদালতে প্রথম দিন কিসমতসহ তিনজনকে হাজির করা হলে বাদীপক্ষের আইনজীবী রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করতে জোরালো আবেদন জানান।
রিমান্ডের আবেদনে উল্লেখ করা হয়, যেহেতু অত্র মামলার আসামি মো. তাজমুল কবির ওরফে তাজুল, মো. হাসান ও সৈয়দ কিসমত আলীরা বাদীর ড্রাম ট্রাকটি চুরি করে খুলনার খানজাহান আলী থানা ৫২ নম্বর বিসিক শিল্প নগরীর রাইছ মিলের মাঠে লুকিয়ে রাখে এবং আসামিদের শনাক্ত মতে র্যাব গাড়িটি উদ্ধার করে; সেহেতু বাকি আসামিদের গ্রেপ্তার করার জন্য আসামিদের পাঁচদিনের রিমান্ড আবশ্যক।
গত ১২ সেপ্টেম্বর তিন আসামিকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে হাজির করে পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন করা হলে আদালত তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পরবর্তীকালে ১৬ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাঁদের জামিন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
গাড়ি চুরি মামলায় বাদীপক্ষের আইনজীবী জাহাঙ্গীর হোসেন মোল্লা জানান, গত ২১ সেপ্টেম্বর জামিন আবেদন শুনানির সময় বাদী আদালতে উপস্থিত ছিলেন। আসামিপক্ষ জামিনের আবেদন জানালে বিচারক বাদীর আপত্তি আছে কি না জানতে চান। বাদী আবদুর রাজ্জাক জানান, তাঁর কোনো আপত্তি নেই। তখন বিচারক জানতে চান, দুদিন আগে মামলা ও রিমান্ডের আবেদন করে এখন কেন আপত্তি না থাকার কথা বলছেন। জবাবে বাদী জানান, তিনি তাঁর চুরি হওয়া গাড়ি পেয়ে গেছেন। তাঁর আর মামলা চালানোর ইচ্ছা নেই। সামনে ঈদ। তাই আসামিরা জামিন পেলে তাঁর কোনো আপত্তি নেই।
এরপর বিচারক তিন আসামির জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন।
আইনজীবী জাহাঙ্গীর হোসেন মোল্লা আরো জানান, আসামিদের সঙ্গে বাদীর মৌখিক আপস হয়েছে। কোনো লিখিত আপস হয়নি। কোনো ভয়-ভীতিও দেখানো হয়নি বলে তিনি দাবি করেন।
এই মামলার ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইনজীবী বলেন, এখন আপস হলেও এই মামলা বিচারিক আদালতে গেলে তখন আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে তাঁদের সাজা হতে পারে।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, রাজধানীর রমনা থানায় গত ৫ সেপ্টেম্বর আবদুর রাজ্জাক বাদী হয়ে একটি গাড়ি চুরির মামলা করেন। মামলায় বাদীর দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা চুরিসহ ড্রাম ট্রাক চুরির অভিযোগ আনা হয়। মামলা নম্বর ৮(৯)১৫। মামলা দায়েরের ছয়দিনের মাথায় ১১ সেপ্টেম্বর খুলনা মহানগরের খানজাহানের নিজ বাসভবন থেকে কিসমতকে আটক করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কিসমত আলীকে সাত নম্বর আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
জামায়াত থেকে আ.লীগে ও গাড়ি চুরি!
খুলনার খানজাহান আলীর একাধিক বাসিন্দা খুলনায় এনটিভির স্টাফ করেসপনডেন্ট মুহাম্মদ আবু তৈয়বকে জানান, সৈয়দ কিসমত আলী আগে জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ছিলেন। ২০০৭ সালে স্থানীয় আফিল জুট মিল জামায়াত নেতা সাবেক সংসদ সদস্য মিয়া গোলাম পরওয়ারের সঙ্গে দখল করে ছিলেন। সেই ঘটনায় তখন কারখানা কর্তৃপক্ষ জামায়াত নেতাসহ সৈয়দ কিসমত আলীর বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিল। গত বছর কিসমত আলী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তাঁর বিরুদ্ধে খুলনার বিভিন্ন থানায় ২২টি প্রতারণার মামলা রয়েছে। খুলনার বাইরে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আছে আরো অন্তত ১২ মামলা।
এ ব্যাপারে খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আবিদ হোসেন জানান, কিছুদিন আগে সৈয়দ কিসমতের বাড়ি থেকে একটি চোরাই গাড়ি উদ্ধার করা হয়। ওই গাড়ি চুরির মামলায় কিসমতকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আবিদ হোসেন আরো জানান, সৈয়দ কিসমত আলীর গাড়ির চালক মূলত এই গাড়ি চুরির সঙ্গে জড়িত।
তবে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণির সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুলনা মহানগরের খানজাহান আলী এলাকায় আফিল জুটমিলের পাশে সৈয়দ কিসমত আলীর নিজস্ব বাড়ি। ওই বাসভবনে খানজাহান আলী পুলিশফাঁড়িও অবস্থিত। নিজ বাড়িতে পুলিশফাঁড়ি থাকায় সৈয়দ কিসমত বিভিন্নভাবে তাঁদের নাম ব্যবহার করেন। তাঁর বাড়ির ফটক এমনভাবে তৈরি করা যে বাসভবনে প্রবেশ করতে হলে পুলিশফাঁড়ির মধ্য দিয়ে তাদের অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হয়।
সৈয়দ কিসমত আলীর মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে খানজাহান আলী থানার ওসি ফরিদুল হক বলেন, তাঁর মামলার কোনো অভাব নেই।