ইজতেমার সময় বাড়ল একদিন, আখেরি মোনাজাত মঙ্গলবার
বৈরী আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে আজ রোববার ফজরের নামাজের পর থেকে শুরু হয়েছে মাওলানা সাদ অনুসারীদের ব্যবস্থাপনায় বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্যায়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও ইজতেমার মাঠ গোছানোর সময়ের স্বল্পতার কারণে দ্বিতীয় পর্যায়ের ইজতেমার সময় একদিন বাড়ানো হয়েছে। ফলে এ পর্যায়ের আখেরি মোনাজাত পূর্ব নির্ধারিত সোমবারের পরিবর্তে একদিন পিছিয়ে মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে অনুষ্ঠিত হবে। আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে ৫৪তম বিশ্ব ইজতেমা।
আখেরি মোনাজাতে কয়েক লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি অংশ নিবেন বলে আয়োজকদের ধারণা। দ্বিতীয় পর্বের প্রথম দিনে রোববার তুরাগ তীরে সোনাবান বিবির শিল্প শহর টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে লাখ-লাখ মুসল্লির উদ্দেশে চলে পবিত্র কোরআন-হাদিসের আলোকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বয়ান।
সকাল সোয়া ৬টায় ভারতের মাওলানা ইকবাল হাফিজের আম বয়ানের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের ইজতেমা শুরু হয়। উর্দুতে করা ওই বয়ানটি বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের কাকরাইল মসজিদের মাওলানা আব্দুল্লাহ মুনসুর। বয়ান শুরুর কিছুক্ষণ পরই শুরু হয় বজ্রসহ বৃষ্টি। বৃষ্টি আর কনকনে শীত উপেক্ষা করেই মুসল্লিরা মাঠে বয়ান শুনেন।
এর আগে তাবলিগ জামাতের জোবায়ের অনুসারীদের ব্যবস্থাপনায় প্রথম ধাপের ইজতেমা শনিবার আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়। সেদিন মধ্যরাতের আগেই প্রথম ধাপে অংশ নেওয়া মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দান ত্যাগ করেন। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে মাওলানা সাদ অনুসারী মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে প্রবেশ করতে শুরু করেন। রোববার বিকেল পর্যন্ত দলে দলে মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে আসেন। টঙ্গী অভিমুখী বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে ছিল মানুষের ভিড়। মঙ্গলবার সকালে আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ ঢল অব্যাহত থাকবে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশের শতাধিক বিদেশি মেহমানও এ পর্বে ইজতেমায় অংশগ্রহণ করছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর জানান, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও ইজতেমার মাঠ গোছানোর সময়ের স্বল্পতার কারণে দ্বিতীয় পর্যায়ের ইজতেমার সময় একদিন বাড়ানোর আবেদন জানান এ পর্বের ইজতেমার মুরুব্বিরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ইজতেমার মুরুব্বিদের সঙ্গে আলোচনা করে আখেরি মোনাজাতের সময় একদিন পেছানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফলে এ পর্যায়ের আখেরি মোনাজাত পূর্ব নির্ধারিত সোমবারের পরিবর্তে একদিন পিছিয়ে মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে অনুষ্ঠিত হবে।
জেলা প্রশাসক জানান, আখেরি মোনাজাতের সময় পিছিয়ে যাওয়ায় ইজতেমাকে ঘিরে নিরাপত্তাসহ সব ব্যবস্থা একদিন বাড়ানো হয়েছে। এজন্য ব্যাপক প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
দুর্ভোগে মুসল্লিরা
রোববার সকালে থেমে থেমে বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস প্রবাহের কারণে দুর্ভোগে পড়েন ইজতেমায় যোগ দেওয়া মুসল্লিরা। বৃষ্টির কারণে ইজতেমা ময়দান এলাকা কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে। ফলে মুসল্লিদের চালাচলে ভোগান্তি পোহাতে হয়। বৃষ্টির কারণে ইজতেমা ময়দানে আগত মুসল্লিরা চটের সামিয়ানার নিচে পলিথিন টানিয়ে বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করেন। কনকনে শীতের মধ্য দিয়ে বৃষ্টিভেজা মুসল্লিদের তাদের মালামাল পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে দেখা গেছে। বৃষ্টির কারণে ইজতেমা ময়দান এলাকা কর্দমাক্ত হওয়ায় মুসল্লিদের চলাচলে ব্যাহত হচ্ছে। প্রয়োজন না পড়লে কেউ তাঁবু থেকে বের হচ্ছেন না। তাঁবুতে অবস্থান করেই দ্বীনের বয়ান শুনছেন তারা। বেলা ১০টার দিকে বৃষ্টি থেমে গেলে ইজতেমা কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে থাকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত আবহাওয়া ছিল স্বাভাবিক।
ইজতেমায় আসা কয়েকজন মুসল্লি জানান, দ্বীনের জন্য মেহনত করতে ইজতেমায় এসেছেন তারা। আল্লাহকে রাজি খুশি করার জন্য, দ্বীনের জন্য মেহনত করতে এলে কোনো কষ্টকেই কষ্ট মনে হয় না। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় এগুলো বান্দার জন্য একটি নিয়ামত ও পরীক্ষা। তাই তারা মহান আল্লাহর সব নিয়ামতের প্রতি সন্তুষ্ট আছেন।
সকালে ইজতেমা মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, প্রথম পর্বের মুসল্লিদের ফেলে যাওয়া ময়লা-আবর্জনা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কর্মীরা তা পরিষ্কার করছেন। ইজতেমাস্থলে লাগানো বেশ কিছু পানি সরবরাহের মোটর খুঁজে না পাওয়া এবং বৈদ্যুতিক তার, বাথরুম ও পানির লাইনের ফিটিংসের মালামাল না থাকায় দ্বিতীয় পর্বে আসা মুসল্লিরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। পরে বিষয়টি সিটি করপোরেশনের নজরে এলে মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলমের নির্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহারের সুবিধার্থে ৩১টি নতুন পানির মোটর এনে তা দ্রুত সংযোগের ব্যবস্থা করে দেন। পরে মাইক, বিদ্যুৎ সংযোগসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করা হয়।
এদিকে সাদ অনুসারী মুরুব্বিরা ইজতেমা ময়দানের বিদেশি কামরায় সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, মাওলানা জোবায়েরপন্থীরা প্রথম ধাপের ইজতেমা শেষে ময়দান ত্যাগ করার সময় একাধিক বাথরুমের কমোড ভেঙে রেখে গেছেন। রান্নার জন্য গ্যাসের লাইন বিচ্ছিন্ন করেছেন। মাইকের সংযোগের তার ছিড়ে ফেলেছেন। পানির বেশ কয়েকটি মোটর নিয়ে গেছেন। রুটি বানানোর যন্ত্রপাতিগুলোও অকেজো করে রেখে গেছেন।
রোববার বয়ান করলেন যারা
বাদ ফজর ভারতের মাওলানা ইকবাল হাফিজ উর্দুতে বয়ান করেন এবং তা বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের আব্দুল্লাহ মুনসুর। বাদ জোহর বয়ান করেন নিজামুদ্দিন মারকাজের শীর্ষ মুরুব্বি মাওলানা আব্দুল বারী। বয়ানটি বাংলায় তরজমা করেন মাওলানা মুনির বিন ইউসুফ। এ ছাড়া বাদ আছর বাংলাদেশের মাওলানা মোশাররফ হোসেন ও বাদ মাগরিব বয়ান করেন দিল্লির মাওলানা শামীম আহমদ। এ বয়ানটি অনুবাদ করেন বাংলাদেশের মাওলানা আশরাফ আলী।
তাশকিলের কামরায় চিল্লাভুক্ত মুসল্লি
ইজতেমার প্যান্ডেলের উত্তর-পশ্চিমে তাশকিলের কামরা স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন খিত্তা থেকে বিভিন্ন মেয়াদে চিল্লায় অংশ গ্রহণেচ্ছু মুসুল্লিদের এ কামরায় আনা হচ্ছে এবং তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। পরে তাবলিগের মুরুব্বিদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এলাকা ভাগ করে তাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাবলিগের দ্বীনের দাওয়াতের কাজে পাঠানো হবে।
গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ওয়াই এম বেলালুর রহমান জানান, ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের সার্বিক নিরাপত্তা, যানজট নিরসনসহ সার্বিক বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। ইজতেমা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে।
বিশ্ব তাবলিগ জামাতের আমির সাদ ও কাকরাইল মসজিদের পেশ ইমাম হাফেজ মোহাম্মদ জোবায়েরের অনুসারী মুসল্লিদের মধ্যে বিরোধ এবং সংঘর্ষের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জানুয়ারি মাসে বিশ্ব ইজতেমা স্থগিত হয়ে যায়। ওই সংঘর্ষের ঘটনায় দুই মুসল্লি নিহত ও পাঁচ শতাধিক আহত হন। পরবর্তী সময়ে দুই পক্ষকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আগ্রহে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
দুই পক্ষের মুরব্বিদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি মাওলানা জোবায়ের এবং ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি সাদ অনুসারীদের ইজতেমা করার কথা। কিন্তু জোবায়েরের অনুসারীরা একদিন আগেই ১৪ ফেব্রুয়ারি ইজতেমা শুরু করেন। তারা শান্তিপূর্ণভাবে গতকাল শনিবার আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে তাদের ইজতেমা শেষ করেন।
আজ থেকে সাদ অনুসারীদের পরিচালনায় ইজতেমা চলছে। মঙ্গলবার দুপুরের আগে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের ইজতেমা।