মক্কার বলী খেলার ১৪০তম আসর কাল

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাতকানিয়া উপজেলার মক্কার বলী খেলার ১৪০তম আসর বসবে কাল শনিবার। এ উপলক্ষে সাতকানিয়ার মাদার্শা মক্কার বাড়ির আশপাশে বিশাল এলাকাজুড়ে বসবে বৈশাখী মেলা।
সকাল থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত চলবে মেলার কার্যক্রম। মেলায় মিলবে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র। বলী খেলা ও বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকার লোকজনের মধ্যে বিরাজ করছে বাড়তি আনন্দ-উৎসাহ।
আয়োজকরা জানিয়েছেন, এ বছর ১৪০তম বলী খেলা অনুষ্ঠিত হবে। খেলা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে জোর প্রস্তুতি চলছে। এরই মধ্যে দেশের নামকরা বলীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে খেলায় তাঁদের উপস্থিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সাতকানিয়ার মাদার্শা মক্কার বাড়ির বংশধর, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও চট্টগ্রাম ইসলামিয়া কলেজের অধ্যাপক ড. আবুল আলা মুহাম্মদ হোছামুদ্দিন বলেন, এখন থেকে তিন শতাধিক বছর আগে তাঁদের পূর্বপুরুষ সৌদি আরবের মক্কার বাসিন্দা ইয়াছিন মক্কী ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সাতকানিয়ায় আসেন এবং মাদার্শার পাহাড়ি এলাকায় বসবাস শুরু করেন। এর পর থেকে এলাকাটি মক্কা বাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়। ইয়াছিন মক্কী এলাকায় ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি কিছু ব্যবসাও শুরু করেন। হজ মৌসুমে তিনি বাংলাদেশের অনেক হাজিকে হজ করানোর জন্য সৌদি আরবে নিয়ে যেতেন। একসময় তিনি সাতকানিয়ার মাদার্শা এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সে সুবাদে সাতকানিয়া ছাড়াও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে তিনি বিপুল পরিমাণ জায়গা কিনে নেন। বিয়েও করেছেন বাংলাদেশ থেকে। ইয়াছিন মক্কী এক হজ মৌসুমে বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু হাজি নিয়ে সৌদি আরবে যান এবং সেখানে মৃত্যুবরণ করেন।
এরপর ইয়াছিন মক্কীর পরবর্তী প্রজন্ম জমিদারি প্রথা চালু করে। ১৮৭৯ সালে ইয়াছিন মক্কীর নাতি কাদের বক্স চৌধুরী খাজনা দিতে আসা প্রজা ও এলাকার লোকজনকে আনন্দ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম বলী খেলার আয়োজন করেন। এর পর থেকে এটি মক্কার বলী খেলা নামে পরিচিত লাভ করেন।
কাদের বক্সের নাতি ও বর্তমানে মক্কার বলী খেলার মূল আয়োজক নাজমুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমার দাদা মূলত খাজনা দিতে আসা লোকজন ও এলাকার মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্য বলী খেলার আয়োজন করতেন। প্রতিবছর বৈশাখ মাসের ৭ তারিখে সবাই দলবেঁধে খাজনা দিতে আসতেন। ওই দিন মক্কার বাড়ি এলাকায় খাজনা দিতে আসা লোকদের ভিড় জমে যেত। আমার দাদা খাজনা দিতে আসা লোকদের জন্য মেজবানের আয়োজন করতেন। খাজনা প্রদানকারী এবং এলাকার মানুষকে বাড়তি আনন্দ দিতে বলী খেলার আয়োজন করতেন। শুরুর দিকে বাড়ির সামনে বিশালাকৃতির একটি গাছের টুকরো রাখতেন। খাজনা দিতে আসা এবং স্থানীয় লোকদের মধ্য থেকে যাঁরা ওই গাছের টুকরো আলগা (উপড়ে তুলতে) করতে পারতেন, তাঁরাই কেবল বলী খেলার উপযোগী হিসেবে বিবেচিত হতেন। পরে তাঁদের মধ্যে মূল প্রতিযোগিতা হতো এবং বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার দিতেন। গাছের টুকরো আলগা করে প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জনকারীরা বলী খেলায় হেরে গেলেও তাঁদের সান্ত্বনা পুরস্কার দিতেন। এভাবে চলতে চলতে মক্কার বলী খেলা একপর্যায়ে এলাকার মানুষের আনন্দের মূল কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়।’
সাতকানিয়া ছাড়াও দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে বলী খেলা দেখতে উৎসুক জনতা মক্কার বাড়ি এলাকায় ভিড় জমান। এর পর থেকে বলী খেলা উপলক্ষে মেলার আয়োজন শুরু হয়।
নাজমুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমার দাদা যেহেতু বৈশাখের ৭ তারিখে খেলার আয়োজন করতেন, আমরাও একই তারিখে বলী খেলা এবং মেলার আয়োজন করি। কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণাহীন এই মক্কার বলী খেলায় চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য লোক খেলা দেখতে ছুটে আসেন। বলী খেলা উপলক্ষে মক্কার বাড়ির আশপাশে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসবে বৈশাখী মেলা। মেলার আগের দিন থেকে দোকানিরা নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন। সেখানে খাবার, কাপড়চোপড়, কসমেটিকসের দোকান ছাড়াও বাঁশ-বেতের তৈরি জিনিসপত্র, নানা কৃষি উপকরণসহ গ্রামীণ পরিবারে সারা বছরের প্রয়োজনীয় যাবতীয় সামগ্রী মেলায় পাওয়া যায়। লোকজন বলী খেলা উপভোগের পাশাপাশি মেলা থেকে ব্যবহারের সব জিনিসপত্রও কিনে নেন।’
নাজমুল জানান, বৈশাখ মাসের ৭ তারিখে সকাল থেকে মেলায় কেনাকাটা হলেও বলী খেলা শুরু হয় মূলত বিকেলে। সমস্ত মেহমান এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বলীদের খাবারের পর দুপুর আড়াইটার দিকে মক্কার বাড়ির লোকজন হলুদ রঙের বিশাল আকৃতির ছাতা মাথায় দিয়ে বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে মাঠে প্রবেশের পর শুরু হয় বলী খেলার মূল কার্যক্রম। মক্কার বাড়ির লোকজন মাঠে উপস্থিত হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা নামকরা বলীরা খালি গায়ে বাজনার তালে তালে নেচে মাঠের চারপাশে কয়েকবার ঘুরে শক্তি প্রদর্শন করবে। ততক্ষণে মেলায় আসা লোকজনের মধ্য থেকে খেলায় অংশ নেওয়ার আগ্রহী বলীদের মাঠের মাঝখানে ডেকে নিয়ে আসে। শুরুর দিকে স্থানীয় বলীরা খেলায় অংশ নেবে এবং ধাপে ধাপে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা সুঠাম দেহের নামকরা বলীরা খেলা শুরু করে।
এবার কক্সবাজারের রামুর দিদার বলী, উখিয়ার শামসু বলী, টেকনাফের আলম বলী, খুলনার শিপন বলী, যশোরের কামাল বলীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নামকরা বলীরা খেলায় অংশ নেবেন বলে জানান।
মাদার্শা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আ ন ম সেলিম উদ্দিন বলেন, মক্কার বাড়ির বলী খেলা পুরো চট্টগ্রামের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী। বলী খেলা উপলক্ষে মক্কার বাড়ির আশপাশে বিশাল মেলা বসে। কোনো ধরনের প্রচারণা ছাড়া এই বলী খেলা ও বৈশাখী মেলায় লাখো মানুষের ঢল নামে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লোকজন বলী খেলা উপভোগ করার পাশাপাশি মেলা থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নেন।
চেয়ারম্যান আরো জানান, বলী খেলা উপলক্ষে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে এখন থেকে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে। মক্কার বলী খেলাকে ঘিরে এখানকার ঘরে ঘরে চলবে উৎসবের আমেজ। প্রতিবছর বলী খেলা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা ছেলে মেয়ে ও আত্মীয়স্বজনরা সবাই বাড়িতে বেড়াতে আসে। একসময় মাদার্শা মক্কার বাড়ি এবং আশপাশের এলাকায় মেয়ের বিয়ের সময় বরপক্ষের সঙ্গে অন্যান্য কথাবার্তার পাশাপাশি বলী খেলার দিন মেয়েকে নিয়ে জামাই বেড়াতে আসার কথাও পাকা করা হতো বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মক্কার বলী খেলা এখানকার মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। বলী খেলা উপলক্ষে তাঁদের বাড়িতে নিকট আত্মীয়স্বজন বেড়াতে আসা অনেকটা নিয়মের মতো। তারা সারা বছরের জন্য ব্যবহৃত বেশির ভাগ জিনিসপত্র মেলা থেকে সংগ্রহ করেন। বলী খেলা উপলক্ষে বসা মেলায় বাঁশ-বেতের তৈরি হরেক রকম সামগ্রী, বিভিন্ন ধরনের গ্রাম্য খাবার, ফল, কৃষি উপকরণ, বাচ্চাদের খেলনা, ঘর সাজানোর নানা রকম জিনিসসহ যাবতীয় সামগ্রী পাওয়া যায়।
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, এটি সাতকানিয়ার ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। মেলা ও বলী খেলা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।