‘জনপ্রশাসন দানব ৪৪ বছর ধরে টিকে আছে’
জনপ্রশাসনকে দানব উল্লেখ করে তা গত ৪৪ বছর ধরে টিকে আছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ডা. বাহারুল আলম। তিনি বলেছেন, ‘ওই দানবের সংখ্যা খুব কম। তারা ৪৪ বছর ধরে টিকে শুধুমাত্র আমাদেরই (বিসিএসের অন্য ক্যাডার) আপসকামিতা, আমাদেরই ভীতি ও আমাদেরই লেজুড়বৃত্তির জন্য। কখনোই টিকে থাকতে পারে না। এত নিয়ম এত কিছু কেন।’
আজ শনিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক (প্রকৃচি)- বিসিএস সমন্বয়ে কমিটির সমাবেশে এসব কথা বলেন বাহারুল আলম।
urgentPhoto
সমাবেশ থেকে আগামী ৮ নভেম্বরের মধ্যে উপজেলা পরিষদে হস্তান্তরিত ১৭ দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার বিলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) স্বাক্ষর দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিলসহ ছয় দফা দাবি না মানলে কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।
কৃত্য পেশাভিত্তিক জনপ্রশাসন প্রতিষ্ঠা, বেতন-স্কেলে সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল পুনর্বহাল, আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন, পদোন্নতির ক্ষেত্রে সমান সুযোগসহ ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ডাকা আজকের সমাবেশে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সর্বস্তরের ক্যাডার, নন ক্যাডার ও ফাংশনাল সার্ভিসের কর্মীরা অংশ নেন। পুরো মিলনায়তন কানায় কানায় ভরে যায়। অনেকে মঞ্চের পেছনে ও মিলনায়তনে দাঁড়িয়ে নেতাদের বক্তব্য শোনেন। যাঁরা মিলনায়তনে জায়গা পাননি, তাঁরা ইনস্টিটিউশনের বাইরে বসে বা দাঁড়িয়ে বক্তব্য শোনেন। এ জন্য বাইরে আলাদা মাইক লাগানো হয়।
এ বিষয়ে প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটির সদস্য-সচিব ও বিসিএস সমন্বয় কমিটির মহাসচিব ফিরোজ খান এনটিভিকে বলেন, ‘ট্রেজারি রুলস অনুযায়ী যারা সেলফ ড্রয়িং কর্মকর্তা তাঁদের যদি সরকারের আরেক কর্মকর্তার সিগনেচারে বেতন-ভাতা-বিল উত্তোলন করতে হয় সেটা বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।’
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটির স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশের (কেআইবি) সভাপতি আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আমলারা তাঁদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য আমাদের পেশাজীবী ও সার্ভিস ক্যাডারের ভাই-বোনদের আজকে এই পর্যায়ে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। অথবা তাঁদের চক্রান্তের ফলে আজকে এটা করতে আমাদের বাধ্য করেছে। আমরা বলতে চাই, আমাদের আন্দোলন অবশ্যই কোনোক্রমে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে নয়। আমাদের আন্দোলন তাদের বিরুদ্ধে যারা একটি গণপ্রগতিশীল গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের পেশাজীবীদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। আমরা কোনোক্রমেই সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাই না। আমাদের এই আন্দোলন ওই চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে যারা আমাদেরকে দাঁড় করাতে চাইছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের এই আন্দোলন। এই আন্দোলন চালিয়ে অবশ্যই আমরা সফল হব।’
সমাবেশে বক্তব্য দেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান, বিএমএর সভাপতি অধ্যাপক মো. মাহমুদ হাসান, মহাসচিব ডা. ইকবাল আর্সলান, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (আইইবি) সভাপতি ও বিসিএস সমন্বয় কমিটির সভাপতি প্রকৌশলী কবির আহমেদ ভূঁইয়া, মহাসচিব মো. ফিরোজ খান, সম্মানিত সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর, কেআইবির মহাসচিব মো. মোবারক আলী, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি নাসরিন সুলতানা, বিসিএস (কৃষি) ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এস তাসাদ্দেক আহমেদ, মহাসচিব খায়রুল আলম প্রিন্স প্রমুখ।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, ঘোষিত বেতন স্কেলে প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া সব ক্যাডার ও সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী মর্যাদা ও আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ প্রশাসন ক্যাডারের নিজস্ব পদ সিনিয়র সহকারী কমিশনার, ডেপুটি কমিশনার, কমিশনার ইত্যাদি পদে তাঁদের পদোন্নতি দেওয়া হয় না। বিধিবহির্ভূত ও অনৈতিকভাবে এবং অবস্থানগত সুবিধার অপব্যবহার করে তাদের সরকারের বিশেষ পদ উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও সচিব পদে নির্ধারিত পদের চেয়ে অতিরিক্ত সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদ না থাকার অজুহাতে বছরের পর বছর একই পদে ফেলে রাখা হয়।
এ ছাড়া উপজেলা পরিষদের জন্য জারি করা সার্কুলারের মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ের সেলফ ড্রয়িং কর্মকর্তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে বলে বক্তারা অভিযোগ করেন। তাঁরা বলেন, ইউএনও নিজেও উপেজেলা পরিষদে একজন ন্যস্ত কর্মকর্তা। অথচ পরিষদকে কার্যকর করার নামে উপজেলা চেয়ারম্যানের চেয়ে ইউএনওকে অধিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ইউএনও একমাত্র কর্মকর্তা যার উপজেলা পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেই। তাই উপজেলা কার্যকর করতে ইউএনওর কর্তৃত্ব বাতিল ও উপজেলা চেয়ারম্যানের ক্ষমতায়ন করতে হবে।
সমাবেশে প্রকৃচি ও বিসিএস সমন্বয় কমিটির ছয় দফা দাবি পড়েন বিসিএস সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও মাদারীপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন নাছিম।
দাবিগুলো হচ্ছে ১. মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব থেকে সচিব/সিনিয়র সচিব পর্যন্ত সব পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ক্যাডার কর্মকর্তা পদায়নের মাধ্যমে কৃত্য পেশাভিত্তিক জনপ্রশাসন গড়ে তুলতে হবে; ২. বেতন-স্কেলে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহাল করতে হবে; ৩. উপজেলাকে কার্যকর করতে ইউএনওর কর্তৃত্ব বাতিল করে জনপ্রতিনিধি হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যানের ক্ষমতায়ন করতে হবে; ৪. আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন করতে হবে। একই সঙ্গে বঙ্গভবন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সব ক্যাডারের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে; ৫. নিজস্ব ক্যাডার ও ফাংশনাল সার্ভিসবহির্ভূত সব ধরনের প্রেষণ বাতিল করতে হবে ও ৬. সব ক্যাডার ও ফাংশনাল সার্ভিসের পদোন্নতির সমান সুযোগ দিতে হবে।
এসব দাবি আদায়ে প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটি সর্বাত্মক আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলে ঘোষণা দেন বিসিএস সমন্বয় কমিটির নেতা মাদারীপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। এ সময় তিনি কমিটির পক্ষ থেকে কিছু কর্মসূচির ঘোষণা দেন। এগুলো হলো : প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমস্যার সমাধানে তাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করা হবে। দ্বিতীয়ত, ২৮ অক্টোবর দেশের সব উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও কেন্দ্রীয়ভাবে দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত মানববন্ধন করা হবে। তৃতীয়ত, উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা বেতন-ভাতা উত্তোলনের ক্ষেত্রে আগের নিয়ম অনুসরণ করবেন। চতুর্থত, ৫ নভেম্বর উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। পঞ্চমত, ৫ নভেম্বরের মধ্যে উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হবে। এরপরও ৮ নভেম্বরের মধ্যে দাবি মানা না হলে পরবর্তীতে আরো কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা করা হয়।
সারা দেশের পেশাজীবীদের যার যার অবস্থান থেকে এসব কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানান বাহাউদ্দিন নাছিম।
গত ৩১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপজেলা পরিষদে ১৭ দপ্তরের হস্তান্তর প্রস্তাব আবার অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রায় দেড় মাস পর গত বৃহস্পতিবার ১৪ অক্টোবর এ-সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
পরিপত্রে বলা হয়েছে, উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮-এর ২৪ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে স্থানীয় সরকার বিভাগের ১৭ জুন ২০১০ তারিখের প্রজ্ঞাপন ও ২০১৩ সালের ৬ জানুয়ারির প্রজ্ঞাপন দিয়ে ওই আইনের তৃতীয় তফসিলে বর্ণিত উপজেলা পর্যায়ের কতিপয় দপ্তর ও কাজ (সংযোজনী-১) উপজেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়। উপজেলা পরিষদকে অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে পরিষদে হস্তান্তরিত দপ্তর ও কাজের সঙ্গে যুক্ত উপজেলা ও ইউনিয়ন বা এর নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এই আদেশ জারির তারিখ থেকে উপজেলা পরিষদের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত হয়েছেন বলে গণ্য হবেন।
অর্থাৎ মোট ১৬টি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এত দিন তাদের মন্ত্রণালয় বা বিভাগ থেকে সরাসরি বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক অর্থ পেলেও এখন তাঁদের ওই অর্থের জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওর যৌথ স্বাক্ষরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। দুজনের যৌথ স্বাক্ষর ছাড়া বেতন বা কোনো রকম বিল উত্তোলন করতে পারবেন না প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি বিরাট অংশ। এতে আগের চেয়ে সময় ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আরো বাড়বে বলে মনে করেন ১৬ দপ্তরের কর্মকর্তারা।