তিতাসের বাড়িতে শোক, প্রতিবাদে মানববন্ধন, তিনটি তদন্ত কমিটি
সরকারের একজন যুগ্ম সচিবের জন্য তিন ঘণ্টা ফেরি আটকে রাখায় অ্যাম্বুলেন্সে থাকা স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যুর ঘটনায় তিনটি তদন্ত কমিটি গঠ্ন করা হয়েছে।
এদিকে নড়াইলের কালিয়ার স্কুলছাত্র তিতাসের বাড়িতে চলছে শোক। তিন দিনেও থামেনি তাঁর স্বজনদের আহাজারি। তিতাসের মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচারের দাবিতে আজ সোমবার তিতাসের বিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকরা কালিয়ায় মানববন্ধন করেছে।
তিনটি তদন্ত কমিটি
একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল হক পাটোয়ারীকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন তিনি। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান, এএসপি (সার্কেল) আবির হোসেন ও বিআইডব্লিউটিসির এজিএম (মেরিন) এ কে এম শাজাহান। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
একই ঘটনা তদন্তে আরেকটি কমিটি গঠন করেছে বিআইডব্লিউটিসি। বিআইডব্লিউটিসির জেনারেল ম্যানেজার মো. আশিকুজ্জামানকে প্রধান করে দুই সদস্যের এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর সদস্য হলেন সংস্থাটির ডিজিএম (মেরিন) মো. ফজলুল হক।
এরই মধ্যে সোমবার দুপুরে আশিকুজ্জামানের নেতৃত্বে বিআইডব্লিউটিসির দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। পরিদর্শনকালে কুমিল্লা ফেরির ইনচার্জ, কাঁঠালবাড়ি ঘাটের বিআইডব্লিউটিসির কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। একই সঙ্গে ঘাট এলাকা পরিদর্শন করেন তাঁরা। তবে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের কিছুই জানাননি তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
এর আগে সোমবার সকালে এ ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শাহনেওয়াজ দিলরুবা খানকে প্রধান করে দুই সদস্যের এ কমিটি করা হয়। কমিটির অপর সদস্য হলেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব শাহ হাবিবুর রহমান হাকিম। কমিটিকে আগামী সাতদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
তিতাসের বাড়িতে শোক
তিতাস কালিয়া উপজেলার বড়কালিয়া গ্রামের মৃত তাপস ঘোষের ছেলে। পড়ত কালিয়া সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে। তিতাসের মৃত্যুতে মা সোনামনির আহাজারিতে গ্রামের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে।
সোমবার তিতাসের বাড়িতে গেলে তার বোন তনিষা ঘোষ অভিযোগ করে বলেছেন, গত ২৪ জুলাই তিতাস একটি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়। প্রথমে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকরা তাকে ঢাকায় নিতে বলেন। পরের দিন ২৫ জুলাই তাকে ঢাকায় নেওয়ার পথে রাত ৮টায় মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ী ১ নম্বর ফেরিঘাটে পৌঁছান। সেখানে জানতে পারেন, একজন ভিআইপি আত্মীয়র বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে ঢাকায় যাবেন, তাই ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে।
নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বড়কালিয়া গ্রামের বাড়িতে তিতাসের মরদেহ ধরে সোনামনির আহাজারি। ছবি : এনটিভি
তনিমা ঘোষ বলেন, তাঁর ভাইয়ের আশঙ্কাজনক অবস্থার কথা জানিয়ে তিনি সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন মহলে ধরনা দিলেও কাজ হয়নি। রাত ১১টার দিকে ওই ভিআইপি ও তাঁর আত্মীয়রা এলে ফেরি চলাচল শুরু হয়। কিন্তু ফেরি পার হতে হতেই তাঁর ভাই বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
তানিমার দাবি, যারা ফেরি আটকে তাঁর ভাইয়ের চিকিৎসায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির।
এদিকে পুত্রশোকে নির্বাক পাথর হয়ে গেছেন তিতাসের মা সোনামনি ঘোষ। বাড়িতে থাকা ছেলের ব্যবহৃত পোশাক বুকে নিয়ে কখনো নীরবে চোখের পানি ফেলছেন, আবার কখনো চিৎকার করে আহাজারি করে চলেছেন। সাংবাদিক পরিচয় পেতেই তিনি হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে বললেন, তাঁর ছেলে বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। ছেলের চিকিৎসায় বাধা সৃষ্টিতে যারা দায়ী তিনি তাদের বিচার দাবি করেছেন।
বিচার দাবিতে বিক্ষোভ
তিতাসের বিদ্যালয়সহ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ফুঁসে উঠেছে। তিতাসের বিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা সোমবার কালিয়া সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার জুড়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে। বিনা চিকিৎসায় তিতাসের মৃত্যুর প্রতিবাদে ও ক্ষমতার দাপটে ফেরি চলাচল বন্ধ করে তার চিকিৎসা কাজে যারা ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে তাদের শাস্তির দাবি জানানো হয় এ সময়।
মানববন্ধনে বক্তব্য দেন কালিয়া সরকারি পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিএম শুকুর আলী, সহকারী শিক্ষক দেব কুমার ঘোষ, তরুণ কান্তি মল্লিক, সাজ্জাদ হোসেন, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইয়াছমিন জনি প্রমুখ।
তিতাসের মামা বিজয় ঘোষ রোববার সন্ধ্যায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, গত বুধবার সন্ধ্যায় এক আত্মীয়ের বরযাত্রীর বহরে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল তিতাস। সদ্য মোটরসাইকেল চালাতে শেখা তিতাস রাস্তায় একটি স্পিড ব্রেকারে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পায়। দ্রুত তাকে খুলনার হাসপাতালে নিয়ে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। পরের দিন চিকিৎসক জরুরি অস্ত্রপচারের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান। প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও সংশ্লিষ্টদের পরামর্শে লাইফ সাপোর্ট অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলেন তারা। রাত ৮টায় মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ী ১ নম্বর ফেরিঘাটে পৌঁছায় অ্যাম্বুলেন্সটি। তখন কুমিল্লা নামের একটি ফেরি ঘাটেই ছিল। কিন্তু সরকারের এটুআই প্রকল্পের যুগ্ম সচিব আবদুস সবুর মণ্ডল পিরোজপুর থেকে ঢাকায় যাবেন। তাঁর গাড়ি না আসা পর্যন্ত ফেরি ছাড়তে রাজি হয়নি ঘাট কর্তৃপক্ষ। মুমূর্ষু তিতাসকে বাঁচাতে তারা জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করেন। সাহায্য চান ঘাটে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কাছেও। কিন্তু কারো অনুরোধই রাখেনি ঘাট কর্তৃপক্ষ।
নড়াইলের কালিয়া উপজেলায় তিতাসের জন্য বিক্ষোভ। ছবি : এনটিভি
প্রায় তিন ঘষ্টা পর রাত পৌনে ১১টার দিকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের স্টিকার লাগানো সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাস আসার পর ফেরি ছাড়ে। তবে ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণে মাঝ নদীতে থাকা অ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যু হয় তিতাসের। অনেক চেষ্টা করেও সময়ের কাছে হেরে যান অ্যাম্বুলেন্সে থাকা চিকিৎসক ও সহকারীরা।
নিহতের স্বজনরা জানায়, তিতাস মারা যাওয়ায় আর ঢাকার দিকে না গিয়ে শিমুলিয়া ঘাট থেকে বাড়ির দিকে অ্যাম্বুলেন্স ঘুরিয়ে দেয় তারা। তবে এমন মৃত্যুর জন্য ওই সরকারি কর্মকর্তা ও বিআইডব্লিউটিসির ঘাট সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানায় নিহতের স্বজন ও স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, সরকারের এটুআই প্রকল্পের যুগ্ম সচিব আবদুস সবুর মণ্ডল পিরোজপুর থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন। তিনি কাঁঠালবাড়ি ঘাটে যাওয়ার আগে আমার কাছে ফেরিতে যাওয়ার বিষয়টি জানান। পরে আমি ঘাটের ব্যবস্থাপক সালামকে ভিআইপি ফেরিতে ওঠার বিষয়ে বার্তা পাঠাই। কিন্তু ওই ঘাটে অ্যাম্বুলেন্সে একজন গুরুতর আহত রোগী আছে, তা আমি জানতাম না। ঘাটের ম্যানেজার এ বিষয় আমাকে কিছু জানাননি। রোববার বিষয়টি জানতে পারলাম আমি।
বৃহস্পতিবার রাতে ফেরিঘাটে দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিসির সহকারী ব্যবস্থাপক ফিরোজ হোসেন বলেন, ‘আমি তখন অন্য ঘাটে ছিলাম। খবর পেয়ে ওই সচিবকে ফেরিতে উঠানোর জন্য ঘাটে আসি। রাত ১০টার দিকে সাংবাদিক পরিচয়ে এক ব্যক্তি রোগীবাহী একটি অ্যাম্বুলেন্স ফেরিতে উঠানোর অনুরোধ করেন। সচিবের গাড়ির সঙ্গে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি রাত ১১টার দিকে ফেরিতে উঠিয়ে দেই। পরে কী হয়েছে তা আমি জানি না।’