শোকে স্তব্ধ শৈলকুপা
তিন শিশুকে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় যেন শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা সদর। এভাবে তিন শিশুকে হত্যার ঘটনা মানতে পারছে না কেউই। শোকাতুর মানুষ কীভাবে এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাবে তাও যেন ভুলে গেছে।
কবিরপুর মসজিদপাড়া গ্রাম এখন শোকের গ্রাম। এখানে কেউ কাউকে সান্ত্বনা দিচ্ছে না, সব মানুষ কথা বলছে চোখের জলে। তাদের সেই ভাষা একটাই, তিন শিশুর হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
অর্থ লেনদেনের জের ধরে গতকাল রোববার সন্ধ্যা ৭টার দিকে শৈলকুপা থানার পেছনে কবিরপুর গ্রামের মসজিদপাড়ায় তিন শিশুকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে, ঘরে তালাবদ্ধ করে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে।
এরা হলো শৈলকুপা পাইলট হাইস্কুলের কারিগরি বিভাগের শিক্ষক দেলোয়ার হোসেনের দুই ছেলে মোস্তফা সাফিন (১০) ও মোস্তফা আমীন (৮) এবং বোন কবিরপুর হাইস্কুলের শিক্ষক জেসমিন আক্তারের ছেলে মাহিম (১৩)। সাফিন ও আমীন স্থানীয় কবিরপুর কিন্ডারগার্টেন স্কুলের তৃতীয় ও প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। আর মাহিম শৈলকুপা পাইলট হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত।
আজ সোমবার বেলা ১টার দিকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে মাহিমের লাশ মনোহরপুর ও দেড়টার দিকে একটি টেম্পুতে করে মোস্তফা সাফিন ও তার ছোট ভাই মোস্তফা আমীনের মরদেহ কবিরপুর আনা হয়। এ সময় নিহত শিশুদের পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশীরা ছাড়াও সেখানে উপস্থিত হাজার হাজার নারী-পুরুষ কান্নায় ভেঙে পড়েন।
সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
নিহত তিন শিশুর স্কুলের সহপাঠী ছাড়াও শিক্ষক-শিক্ষিকারা সেখানে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শিশুদের লাশ একনজর দেখতে উপজেলা সদরের পাড়ামহল্লাসহ দূর-দূরান্তের গ্রামের মানুষের ঢল নামে। সবার চোখেই ছিলো জল। এ সময় সাংবাদিকদের জন্য ক্যামেরায় চোখ রেখে ছবি তোলাও কঠিন হয়ে পড়ে।
জানাজা শেষে বিকেলে দুই সহোদর মোস্তফা সাফিন ও মোস্তফা আমীনকে কবিরপুর কবরস্থানে এবং তাদের ফুফাতো ভাই মাহিমকে গ্রামের বাড়ি মনোহরপুরে দাফন করা হয়।
তিন শিশু হত্যায় জড়িত সন্দেহে শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন ও শিক্ষিকা জেসমিন আক্তারের ভাই ইকবালকে (৪৩) আটক করেছে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, ইকবাল প্রাথমিকভাবে ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।
ইকবাল কবিরপুর গ্রামের গোলাম নবীর ছেলে। তিনি শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। পরে নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি থেকে ২০০৬ সালে ডিপ্লোমা পাশ করেন। এরপর তিনি চাকরি নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে যান। আট বছরের বেশি সময় সিঙ্গাপুরে ছিলেন। চার মাস আগে বাড়ি আসেন। সিঙ্গাপুর থেকে তিনি বাবা গোলাম নবীর কাছে অর্থ পাঠাতেন। সেই টাকা লেনদেনের জের ধরে এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তিন শিশু হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে ও জড়িত ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শোকাহত মানুষ আজ সকাল থেকেই উপজেলা সদরে রাস্তায় নেমে আসে। শত শত মানুষ শৈলকুপা থানার সামনে ভিড় জমায়, সেখানে ইকবালকে পুলিশি হেফাজতে রাখা হয়েছে। ইকবালের বিচারের দাবিতে হাজারো মানুষ খণ্ড খণ্ড বিক্ষোভ মিছিল করেন। দুপুর ১২টার দিকে উপজেলা সদরের চার রাস্তার মোড়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন তারা। সমাবেশে নিহত সাফিন, আমীন ও মাহিমের সহপাঠীদের সঙ্গে তাদের মায়েরাও যোগ দেন।
সমাবেশে নিহতদের স্কুলের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশে বক্তব্য দেন শৈলকুপা বণিক সমিতির সভাপতি আব্দুস সোবাহান, শৈলকুপা পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. মহিদুল ইসলাম, প্রধান শিক্ষক মো. রেজাউল করিম, শৈলকুপা দোকান মালিক সমতির সাধারণ সম্পাদক মুন্সি রবিউল ইসলাম প্রমুখ। বক্তব্য দেওয়ার সময় অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
শৈলকুপা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম ফারুক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, মাহিম হাস্যোজ্জ্বল ও বিনয়ী ছিল। দীর্ঘ পাঁচ বছর তিনি ওকে প্রাইভেট পড়িয়েছেন। গতকাল রোববারই সে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলো।
এলাকাবাসী জানায়, দেলোয়ার ও ইকবালের পাশাপাশি পাকা বাড়ি। মাঝখানে থাকেন তাঁদের মা-বাবা। স্ত্রী শিউলি ও দুই ছেলে সাফিন ও আমীনকে নিয়ে ভালোভাবেই সংসার চলছিল দেলোয়ারের।
শিক্ষকতার সুবাদে জেসমিনও থাকতেন কবীরপুরে। তাঁর স্বামী রাশেদ কীটনাশক ব্যবসায়ী। মাহিম ছিলো তাদের একমাত্র ছেলে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেকে নিয়ে থাকতেন ভাইদের বাড়ির কাছেই।
এদিকে শৈলকুপা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) এমদাদুল হক এনটিভি অনলাইনকে জানান, ইকবালকে থানায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। জনতার ভিড়ের কারণে দুপুরে তাঁকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেখানে রেখেই তাঁকে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
শৈলকুপার থানার এসআই সাজ্জাদ হোসেন জানান, ঘটনাস্থল থেকে গ্যাস সিলিন্ডার, হত্যার সময় ব্যবহার করা হাতুড়ি, রক্তমাখা জামা-কাপড়সহ বেশকিছু মালামাল জব্দ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে তালা দিয়ে দেওয়া হয়েছে হত্যাকাণ্ডের কক্ষটি।
শৈলকুপা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুহাম্মদ শাহজাহান সিরাজ সাংবাদিকদের জানান, এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। মামলার প্রক্রিয়া চলছে। মামলা হলেই আগামীকাল মঙ্গলবার ইকবালকে সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হবে বলে জানান ওসি।
আজ সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জেলা পুলিশ সুপার মো. আলতাফ হোসেনসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।