সাপ নিয়ে স্বপ্ন
সাপ শব্দটা শুনলেই ভয়ে গা কেমন ছমছম দিয়ে ওঠে। আর চলতে ফিরতে কেউ যদি সাপের মুখে পড়ে যায়, তাহলে তো ভোঁ দৌড়। কিন্তু সেই ভয়কেই জয় করার প্রতিজ্ঞা করেছেন রাজবাড়ীর কয়েকজন যুবক। তাঁরা স্বপ্ন দেখছেন সাপ নিয়ে। গড়ে তুলেছেন সাপের খামার। কিন্তু তাঁদের স্বপ্ন পূরণের পথে বাদ সেধেছে সাপের বাণিজ্য নিয়ে সরকারি কোনো নীতিমালা না থাকা।
সরেজমিনে রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার কাশাদহ গ্রামে গিয়ে লোকজনকে জিজ্ঞেস করতেই তাঁরা খামারের পথ দেখিয়ে দেন। সেখানে গিয়ে দেখা গেল উৎসুক মানুষের ভিড়। খামারের ভেতরে একটি কক্ষে প্রজাতি অনুযায়ী আলাদা আলাদা বাক্সে রাখা হয়েছে প্রতিটি সাপ। কোনো কোনো প্রজাতির জন্য তৈরি করা হয়েছে আলাদা চৌবাচ্চাও। খামারের উদ্যোক্তারাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সাপ দেখাচ্ছিলেন আগন্তুকদের। উদ্যোক্তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রবিউল ইসলাম রঞ্জু।
খামারে গোখরা, কমনক্রেট, রাসেল ভাইপার, দাঁড়াশ, ব্যান্ডেক্রিট, পঙ্খীরাজ, ঘরবাইনি, সুতানলি কী নেই? দেশি প্রজাতির প্রায় সব সাপই আছে। উদ্যোক্তারা জানান, খামারে বর্তমানে ৫০টিরও বেশি বিষধর সাপ আছে। এসব সাপের বিষ ওষুধের জন্য অত্যন্ত অপরিহার্য ও দামি কাঁচামাল।
রবিউল ইসলাম রঞ্জু এনটিভি অনলাইনকে জানান, চার বছর আগে টেলিভিশনে বিভিন্ন চ্যানেলে সাপ পালনের ওপর প্রতিবেদন দেখে তিনি আগ্রহী হন। নিজে রাজবাড়ী সরকারি কলেজে প্রাণিবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনাও করেছেন।
কাঁচামালের জোগান আর কর্মসংস্থানের সন্ধান
রঞ্জু বলেন, ‘পাঁচ-ছয়জনকে সঙ্গে নিয়ে আমি এ উদ্যোগ নিই। দেশের ওষুধশিল্পে সাপের বিষের পর্যাপ্ত সরবরাহ ওই শিল্পে গতি আনবে। বিষ উৎপাদন করে দেশে ও বিদেশে সরবরাহ করাই আমাদের উদ্দেশ্য। দেশের বিভিন্ন বিষধর সাপের বিষের চাহিদা বিদেশে অনেক। এসব সাপ নিয়মিত সংগ্রহ করার পাশাপাশি উৎপাদন করে সংখ্যা বাড়ানো গেলে বাংলাদেশই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।’
নাড়াকাঠি দিয়ে সাপ নেড়ে নেড়ে আবার কখনো বা হাত দিয়ে সাপের মুখ ধরে দেখাচ্ছিলেন খামারের কর্মী শফিকুল ইসলাম। ‘সাপ পুষতে দুধ-কলা’ নয়, মুরগির বাচ্চা আর ইঁদুর সাপেদের খুব পছন্দের খাবার বলে জানান শফিক।
স্নেক ফার্মিং অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বোরহান বিশ্বাস রোমেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য সাপের খামার গড়ে তুলে বিষের সরবরাহ নিশ্চিত করা। আমাদের ওষুধ শিল্প দারুণভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর অন্যতম কাঁচামাল বিষ আনতে হয় বিদেশ থেকে। এ ছাড়া বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্যও তা বেশ লাভজনক। আর ওঝা বা সাপুড়ে, সাপ নিয়ে বহু বছর ধরে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আমরা করেছি। এতে তাঁরা নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রেখেই জীবনধারণ করতে পারবেন।’
কালুখালী উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে কয়েকজন যুবক মিলে খামারটি গড়ে তুলেছেন। বেশ ভালো এবং সম্ভাবনাময় শিল্প সাপ পালন। সাপের বিষের পাশাপাশি চামড়া এবং পূর্ণাঙ্গ সাপও বিদেশে রপ্তানি করা যায়। কিন্তু রপ্তানিমুখী পণ্যের তালিকায় সাপ, সাপের চামড়া, বিষ এসব নেই। তালিকাভুক্ত হলে সরকার এ শিল্পের ওপর গুরুত্ব দেবে।’
সঙ্গী হোক সরকার
রঞ্জু জানালেন, রপ্তানিমুখী পণ্যের তালিকায় সাপ, সাপের বিষ অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি দরকার নীতিমালা প্রণয়নের। সাপের বিষ, চামড়া রপ্তানি নীতিমালায় না থাকায় ইচ্ছা থাকলেও বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়া যায় না। নিবন্ধন করে যদি সরকার ব্যবসাটির প্রসারে সাহায্য করে তবে সরকারেরই লাভ। বেসরকারি পর্যায়ে এসব খামার গ্রামীণ অর্থনীতি বদলে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে তিনি জানান।
সাপুড়েরা পাচ্ছেন জীবন
বংশগতভাবেই সাপ ধরেন ইদ্রিস ফকির। দূর-দূরান্তের বন-বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়ান। সাপের খেলা দেখানোর আগে তাঁর কাজ সাপ সংগ্রহ করা। তিনি জানেন, কোন প্রজাতির সাপ কোথায় থাকে, কীভাবে থাকে। তিনি বলেন, ‘দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াই। সাপের খেলা দেখাই। সাপ সংগ্রহ করি। আমাদের কাছ থেকে সাপ কেনার তেমন কেউ নেই। এসব খামার যদি থাকে তবে আমরাও সাপ সংগ্রহ করে এসব খামারে বিক্রি করতে পারব।’
স্নেক ফার্মিংয়ের বোরহান বিশ্বাস বলেন, ‘সাপের খামারের ফলে সাপুড়ে গোষ্ঠীও প্রাণ ফিরে পাবে। নিজেদের ঐতিহ্য ধরে আরো পেশাদারিভাবে এরা সাপ সংগ্রহ করতে পারবে। আর খামারের পক্ষ থেকেই এদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়।’