আত্মসমর্পণ না করলে সরকার আদালতের আদেশ মানতে বাধ্য হবে : প্রধানমন্ত্রী
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সংলাপের প্রস্তাব আবারও নাকচ করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, উনি আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছেন। আন্দোলনের নামে সহিংস কর্মসূচির প্রতি শুধু এ দেশের মানুষই নয়, অন্য কোনো দেশও সমর্থন দিচ্ছে না।
আজ শনিবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। আদালতের নির্দেশনা মেনে খালেদা জিয়াকে আত্মসমর্পণের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, অন্যথায় সরকার আদালতের রায় মানতে বাধ্য হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া নিজ সিদ্ধান্তেই নির্বাচন করেননি। তবে সেই নির্বাচনকে সারা বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়েছে। তাঁর সেই ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত কেন জনগণ দেবে?
শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘খালেদা জিয়া আন্দোলনে ব্যর্থ, জনসমর্থনে যে আন্দোলন তা তিনি করতে পারেন নাই। আজ উনি জনগণের ওপর প্রতিশোধ নিতে চান নিজের ভুলের সিদ্ধান্তের খেসারত হিসেবে। কেন? তিনি যাদের মুখাপেক্ষী হয়েছেন তাঁদের কারো কাছেই তিনি সাড়া পাননি, না উত্তর না পশ্চিম। কোনো দেশ, কোনো মহলই তাঁকে সাড়া দেয়নি। কারণ তাঁর ওই জঙ্গিরূপে কেউ সাড়া দিতে পারে না। মানুষকে পুড়িয়ে মারা কেউ সমর্থন করতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘এখন উনি সংলাপ সংলাপ করে যাচ্ছেন। ফোন করলে গালি শুনব। ছেলে মরলে ঘরের সামনে গেলে ঢুকতে দেবে না, গেটে তালা, তাহলে সংলাপ কি আকাশে হবে? তার সঙ্গে কিসের সংলাপ, যিনি খুনি, যার হাতে রক্ত, যার হাতে মানুষের পোড়া গন্ধ তার সাথে কোনো সংলাপ নয়।
‘শুধু আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এসেছে বাংলাদেশের মানুষ ২১ বছর পরে আবার উপলব্ধি করেছে যে সরকার জনগণের সেবক, জনগণের কল্যাণ করে, জনগণের মঙ্গল করে। ৯৬ থেকে ২০০১, পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশের জন্য বাঙালী জাতির জন্য স্বর্ণযুগ ছিল। কিন্তু ২০০১ এ আবার সেই অমানিশার কালো অন্ধকারে ঢেকে যায় এই দেশ।’
‘নিজের লোকরাই মানে না’
‘কি আন্দোলন উনি করছেন? উনি অবরোধ ডাক দিয়েছেন, হরতাল ডাক দিয়েছেন। তার হরতাল তো তার দলের নিজের লোকরাই মানে না। বিএনপি নেতাদের শিল্প কলকারখানা চলে, অফিস আদালত চলে, গার্মেন্টস চলে এবং তারা গাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। যিনি নিজেকে অবরুদ্ধ করেছেন তার অফিসে, অফিসে অবরুদ্ধ করে রেখে উনি প্রতিনিয়ত কর্মসূচি ঘোষণা দিচ্ছেন। আর সেই কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে উনি বসে আছেন। ওখানে বসে বোধহয় উনি স্বপ্নে বিভোর যে সারাদেশের মানুষ উনার এই মানুষ পোড়ানো, গাড়ি পোড়ানো, মানুষের ক্ষতি করা এগুলোকে খুব বাহবা দিচ্ছেন। এই চিন্তা উনার মাথায় কে ঢোকাচ্ছে আমি জানি না।’
খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উনি গতকালকে যে প্রেস ব্রিফিং দিলেন তাতে তো সেই কথাই মনে হয় যে উনার মাথার মধ্যে কেউ ঢুকিয়েছে যে উনি খুব মহৎ কাজ করে ফেলছেন বাংলাদেশে। কি মহৎ কাজ? মানুষ খুন করছেন, পুড়িয়ে মানুষ মারছেন। এই পোড়া মানুষগুলি কারা? এদেশের খেটে খাওয়া মানুষ, বাসের ড্রাইভার। যে কাজ তিনি শুরু করেছিলেন নির্বাচন ঠেকানোর নাম করে ২০১৩ সালে। গাছ কাটা, নাস্তা কাটা, মানুষ পোড়ানো.....ঘরে ঘরে ঢুকে মানুষ মারা। ঠিক একই কাজ তিনি আবারও শুরু করেছেন।’
‘আমি নিজে টেলিফোন করেছিলাম’
‘খালেদা জিয়া নির্বাচনে আসে নাই। এটা তো তার সিদ্ধান্ত। উনি এখন সমঝোতা চান, এখন কথা বলেন। আমি নিজে আপনারা জানেন যে টেলিফোন করেছিলাম। আর সেই টেলিফোনের কি উত্তর আমি পেয়েছিলাম, সেটা আপনাদের জানা আছে। যে ঝাড়ি আর যে কথা যে বাচনিক আমার জীবনেও ওইরকম শুনি নাই। ওই রকম ঝগড়াটি কথা আমার জীবনে শোনা নাই। থ’ হয়ে গেসিলাম, আমি কোনো উত্তরই দিতে পারি নাই। আলোচনা, সংলাপ, ডায়লগ করে করে উনি এখন গলা শুকাচ্ছেন। কিন্তু যখন আমি নিজে ফোন করলাম, সকাল ১১টায় ফোন করেছি, সেই ফোন ধরতে সময়...ফোন ধরতেও না, উনি তারপরেও ফোন করে নাই। আমার এডিসিকে জানালো উনি ছয়টার পরে কথা বলতে পারবে। আমরা ছয়টার পর বসে আছি ফোন করে না। ওই ভদ্রতাটুকু তার নাই যে একটা টেলিফোন করলে সেই ফোনটা ফিরতি ফোন করতে হয়। ওইটুকু ভদ্রতা জ্ঞানও তার ছিল না।.....আমিই আবার ফোন করি। ফোন করার পরেই যে কথা শুনলাম তা আপনারা নিজেরাই জানেন।’
‘আয়নায় নিজের চেহারাটা একটু ভালো করে দেখলে হয়’
এ সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ক্ষমতাদখল প্রসঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। এই ক্ষমতাদখল অবৈধ বলে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অবৈধ ক্ষমতা দখল করে যে পঞ্চম সংশোধনী সে দিয়েছিল সেটাকেও অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। কাজেই জিয়াউর রহমান আগে ক্ষমতা দখল করেছে অবৈধভাবে তারপরে কিন্তু বিএনপি নামক এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করেছে। যিনি ক্ষমতা দখল করেছন তিনি যদি অবৈধ হন তাহলে তার হাতে সৃষ্টি করা দল সেটা তাহলে কি হবে? তো খালেদা জিয়া আমাদের ৪০ ভাগ ভোট পেয়ে নির্বাচিত পার্লামেন্ট আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তাকে অবৈধ দ্যাখে। আয়নায় নিজের চেহারাটা একটু ভালো করে দেখলে হয় যে তার দলটাই তো অবৈধ প্রকৃতপক্ষে।’
‘এরা তো তারই প্রিয় ব্যক্তিত্ব’
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার আদালতে না যাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে বিচার বিভাগের ওপর তার কোনো আস্থা নেই। কোনো বিশ্বাস নেই। এতিমের টাকা মেরে খেয়েছে মামলা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। আমার আমলে না। ফখরুদ্দিন সাহেবকে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে এনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর খালেদা জিয়াই করেছিল। আর্মিতে নয়জন মেজর জেনালেকে ডিঙিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান করেছিল মঈনউদ্দিনকে খালেদা জিয়াই করেছিল। কাজেই এরা তো তারই প্রিয় ব্যাক্তিত্ব। তারা যদি উনার বিরুদ্ধে মামলা দেয় তো আমরা কি করবো? বিচার তার আপন গতিতে চলে। মামলা চলছে।’
‘এতোগুলি সাংবাদিক গেল কিভাবে’
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রেস কনফারেন্সে উনি বললেন, আমাদের মিডিয়া নাকি নিয়ন্ত্রিত, মিডিয়ার না কি স্বাধীনতা নেই। আমার প্রশ্ন উনি প্রেস কনফারেন্স করলেন, আমাদের বেসরকারি চ্যানেল, যেগুলো আমার হাতে দেওয়া। তারা তো সরাসরি প্রচার করলো.....মিডিয়ার যদি স্বাধীনতা না থাকবে তাহলে তার বক্তৃতা, একজন আসামি, ফেরারি আসামি, শুধু আসামিই না সে কিন্তু কোর্টের স্বীকৃত ফেরারি আসামি। সেই ফেরারি আসামি প্রেস কনফারেন্স করলো এবং সেখানে মিডিয়া গেলো। কই সরকারের পক্ষ থেকে তো আমরা বাধা দিতউনি। উনি না কি অবরুদ্ধ। তাহলে সেই অফিসে এতোগুলি সাংবাদিক গেলো কিভাবে? এতোগুলি ক্যামেরা গেলা কিভাবে? আর তার সেই বক্তব্য সরাসরি প্রচার করলো কিভাবে?’
‘আমি নাকি ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গ্রেনেড মেরেছি’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘উনার শুরুর বক্তৃতা হচ্ছে মিথ্যাচার দিয়ে। কাজেই আর বাকি যা আছে সবই মিথ্যাচারে ভরা। যত অপকর্ম নিজে করেছেন, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে ঢেলেছেন। এটাও তাদের চরিত্র। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারেন তিনি, দোষ দেন আমাদের। ২১ আগস্ট যখন গ্রেণেড হামলা হয়েছিল, তখনও এই একই কাজ করেছিল।....সোজা বলে দিল এই গ্রেনেড না কি আমরাই মেরেছি। আমি না কি ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গ্রেনেড মেরেছি। এই কথাও তারা প্রচার করেছে। সমস্ত আলামত তারা নষ্ট করলো। জজ মিয়া নাটক সাজারলো।’
‘ওরে বাবারে এ দেখি আমার মা’
গতকাল খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের দেওয়া বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘উনি হিটলারের কথা বলছেন। হিটলারের গোয়েবলস যদি আজ বেঁচে থাকতো তো উনার মিথ্যাচার শুনে লজ্জা পেতো যে, ওরে বাবারে এ দেখি আমার মা।’
এসময় প্রধানমন্ত্রীর কথায় তালি দিয়ে এবং হেসে জবাব দেন উপস্থিত জনেরা।
নিজের বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সরকারের করা বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
‘এখন জয়ের পিছনে লেগেছে’
এফবিআইকে ঘুষ দিয়ে বিভিন্ন গোপন নথি সংগ্রহ করার কথা বলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। এফবিআইএর অফিসারকে পর্যন্ত তারা ঘুষ দিতে পারে। তাহলে কত টাকা তার আছে। এবং তারা বলেছে বিএনপির হাই কমাণ্ড থেকেই না কি এই টাকা পয়সা দেওয়া হয়েছে। কেনো? জয়ের বিরুদ্ধে তারা ষড়যন্ত্র করছে, তাকে অপহরণ করবে, তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত। এই চক্রান্ত করার জন্য এফবিআইএর অফিসার কে পর্যন্ত তারা ঘুষ দিয়েছে। ঘুষ দিতে পারে যখন আমেরিকার একটা অফিসারকে তাহলে কত টাকা তাদের আছে? কত কোট কোটি তারা লুটে খেয়েছে সেটাও আপনারা চিন্তা করে দ্যাখেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমান যেমন জড়িত, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে খালেদা জিয়া, তার ছেলে এবং তার মন্ত্রী পরিষদ সদস্য, তারা আমসাকে হত্যার চেষ্টা করেছে বারবার। আবার এখন জয়ের পিছনে লেগেছে। অপরাধটা কি?’
‘কুকুর কামড়ালে আমি তো আর কুকুরকে কামড় দিতে পারি না’
খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর সমবেদনা জানাতে গুলশানে যাওয়ার দিনের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এদের চরিত্রটা আপনারা একবার দ্যাখেন। উনার ছেলে মারা গেলো। নানাভাবে দুব্যবহার করেছে। তারপরেও সন্তান মারা গেছে মা’কে শোক জানাতে আমি ছুটে গেলাম। গেটে তালা দিয়ে দিলো আমাকে ঢুকতে দিলো না। আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। কিন্তু আমি এদেশের প্রধানমন্ত্রী। আমি যদি চাইতাম তক্ষণই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারতাম। যে এতো বড় অডাসিটি কেউ দেখাতে পারে না। আমি সরকার প্রধান আমি গেলাম আমাকে ঢুকতে দেবে না। এতো সাহস কোত্থেকে আসে। আমি কিচ্ছু বলিনি। ঠিক আছে একটা শোকের বাড়ি। কারণ কুকুর কামড়ালে আমি তো আর কুকুরকে কামড় দিতে পারি না।’